ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্র শিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রায় নিরঙ্কুশ জয় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এবারই প্রথম এমন বিজয় অর্জন করল তারা।
নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিজয়ীদের সাথে তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোটের দূরত্বও বেশ কয়েক হাজারের।
ডাকসুর ভিপি পদে জয়লাভ করা সাদিক কায়েমের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খানের ভোটের ব্যবধান নয় হাজারেরও বেশি।
নির্বাচনের ফলাফল ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি পদের বিপরীতেই এই ব্যবধান লক্ষ্যণীয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিগত ২০ – ২৫ বছরের প্রকাশ্য ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্র শিবিরের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।
প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্রশিবিরের ডাকসু ও হল সংসদের এই বিজয়ে তাহলে কোন কোন 'ফ্যাক্টর বা অনুঘটক' কাজ করেছে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ডাকসুর সাবেক ছাত্রনেতারা মনে করেন, জুলাই – অগাস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনা থেকে মাঠ পর্যায়ের সব নেতৃত্বে শিবিরই ছিল, এমন ন্যারেটিভই ডাকসু নির্বাচনে তাদের জয়লাভের অন্যতম একটি কারণ।
বিশ্লেষকরাএ-ও বলছেন, অন্য ছাত্র সংগঠনের 'পদ-পদবি নিয়ে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে' থেকেও নিজেদের সংগঠনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা-কর্মীদের অনেকে। যারা আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ছাত্রশিবিরের ব্যানারে প্রকাশ্যে এসেছেন।

জুলাই গণ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব কার?
বিবিসি বাংলার সর্বশেষ খবর ও বিশ্লেষণ এখন সরাসরি আপনার ফোনে।
ফলো করুন, নোটিফিকেশন অন রাখুন
বিবিসি বাংলার সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল
আজ সকালে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার পর ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি ও ছাত্রশিবির নেতা সাদিক কায়েম, " যে কেউ যে মতেরই হোক না কেন সবাই একসঙ্গে কাজ করার " প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
তিনি প্রথমেই জুলাই গণ অভ্যুত্থানে নিহতদের স্মরণ করেন। এই জয়ে জুলাইয়ের আকাঙ্খার বিজয় হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অর্থাৎ গণ অভ্যুত্থানকেই ডাকসুর নির্বাচনে বিজয়ের ক্ষেত্রে মূল প্রেক্ষাপট বলে মনে করেন তিনি।
আর শিবিরের ঢাবি শাখার সভাপতি ও ডাকসুর নবনির্বাচিত জিএস এস এম ফরহাদ জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাকে যোগ্য মনে করেছেন তাকেই ভোট দিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন মনে করেন, গত এক বছরে জুলাইয়ের গণ অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের যে ন্যারেটিভ দাঁড় করানো হয়েছে, তা ভোটারদের প্রভাবিত করেছে।
অধ্যাপক নাসরীন এ-ও বলেন, "গণ অভ্যুত্থানের মালিকানা নিয়ে যে বাহাস ছিল, সেখানে শিবির বলেছে, গণ অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনা থেকে আন্দোলনের নেতৃত্বের সব কিছুতে যেমন - প্রোফাইল লাল করা, এক দফার দাবি, স্লোগান সবকিছুর মূলে ছিল তারা। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে তারা তখন পরিচয় সামনে আনেনি"।
অন্যদিকে, ডাকসুর সাবেক ছাত্র নেতা মুশতাক হোসেন মনে করেন, স্বাধীনতার পর থেকে যে ধারার রাজনীতি প্রচলিত তার থেকে বর্তমান প্রজন্ম আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
নানা বৈষম্যের বিপরীতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর নানা প্রতিশ্রুতিতে তাদের সুযোগ দেওয়ার কথা তরুণ প্রজন্ম বিবেচনা করেছে বলে মনে করেন সাবেক এই ছাত্রনেতা।
১৯৮৯-৯০ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ থেকে ডাকসুর জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন মি. হোসেন।
সেই সময় ছাত্রশিবিরও নির্বাচন করেছিল বলে জানান তিনি। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা 'সম্ভবত তাদের একটা চান্স দিতে চাচ্ছে' বলে মনে করেন তিনি।
" জুলাই গণ- অভ্যুত্থানে র্যাডিকেল ইসলামিস্ট শক্তি যে ভূমিকাটা নিয়েছে, সেটা না হলে শেখ হাসিনার শক্তিশালী শাসনের হাত থেকে মুক্ত হওয়া যেতো না। এটি সিমপ্যাথি হিসেবে হয়তো কাজ করেছে বলে আমার মনে হয় " বলেন মি. হোসেন।
তবে শিবিরও যদি ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী পথে যায় তবে তাদের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ সংঘটিত হতে বেশি সময় লাগবে না বলে মন্তব্য করেন ডাকসুর সাবেক এই জিএস।
কিন্তু এই দলটির রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে 'লিবারেল ডেমোক্রেটিক' ধারার রাজনীতি যায় কিনা সে প্রশ্নও রয়েছে মি. হোসেনের।

ছবির উৎস, Screen Grab
ছবির উৎস, Screen Grab
গণ-অভ্যুত্থানের পর আত্মপ্রকাশ
বিশ্লেষকরা জানান, ঢাবিতে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে পরিবেশ পরিষদ গঠিত হয়েছিল।
ওই দশকেই পরিবেশ পরিষদের বৈঠকে শিবির ও ছাত্র সমাজ নিষিদ্ধ হয়।
ডাকসুর সাবেক ছাত্রনেতা মি. হোসেন জানান, পরবর্তীতে সীমিত আকারে ছাত্র রাজনীতি চালিয়ে যায় ছাত্র শিবির।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবি যখন থেকে জোরালো হয়, তখন থেকেই তারা গোপনে রাজনীতি চালাতে শুরু করে, বলেন মি. হোসেন।
" যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হওয়ার পরে শিবিরের সঙ্গে সাধারণ ছাত্রদের কতগুলো সংঘর্ষ হয়েছে। তারা এই বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে ছাত্রদের মুখোমুখি হয়। তখন থেকেই শিবিরের বিরুদ্ধে একটা অচ্ছুত নিষেধাজ্ঞা ছিল। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আইনেই তাদের নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় " বলেন মুশতাক হোসেন।
ছাত্র শিবিরের কোনো কোনো নেতা ছাত্রলীগের পদ-পদবী নিয়ে নিজেদেরকে সংগঠিত করার পুরো সুবিধা ভোগ করেছে বলে অভিযোগ করেন সাবেক এই ছাত্রনেতা।
প্রসঙ্গত, জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর গতবছরের সেপ্টেম্বরে এস এম ফরহাদ শিবিরের ঢাবি শাখার সভাপতি হিসেবে নিজের পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করেন।
এরপরই সোশ্যাল মিডিয়ায় তার পরিচয় নিয়ে নানা আলোচনা আছে।
অভিযোগ ওঠে মি. ফরহাদ জসিমউদ্দিন হল শাখা ছাত্রলীগের পদধারী নেতা। হল ছাত্রলীগের সমাবেশে তার উপস্থিতির একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল।
যদিও ছাত্রশিবির এ বক্তব্য মানতে রাজি নয়।
ছাত্রদলসহ অন্যদের বিপর্যয় কেন
গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখ সারি বেশ কয়েকজন নেতাও ডাকসুর এই নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু ভোটে হেরে গেছেন তারা। ছাত্রদলেরও বিপর্যয় হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন মনে করেন, ওই হারের পেছনে কাজ করেছে গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই চাঁদাবাজি, দুর্নীতি বা বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ওঠেছে। তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের বিবেচনায় এই বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলগুলোর প্রায় বেশিরভাগ ভোটই পড়েছে ছাত্রশিবিরের ঝুলিতে।
পাঁচই অগাস্টের পরবর্তী গত এক বছরে সরকারের ওপর কোন দলের নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব বেশি, কে দেশ চালাচ্ছে- এমন বিষয়ও ডাকসু ও হল সংসদের ভোটাররা মাথায় রেখেছেন বলে মনে করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
" কারা সরকারের ওপর অদৃশ্য প্রভাব রাখছে, সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে এসব বিষয় মাথায় রেখেছেন ভোটাররা। কারণ এদেশে ভোটাররা চিন্তা করেন, কে ক্ষমতায় আসতে পারবে? আমার একটা ভোট নষ্ট করবো না? " বলেন মিজ নাসরীন।
এমন বিবেচনাও দেশের স্বাধীনতার পরে নবমবারের মতো অনুষ্ঠিত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে বলে জানান মিজ নাসরীন।
এই নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করেছেন পরাজিত ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সম্মুখ সারির সাবেক নেতা উমামা ফাতেমা।