খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বিল ডাকাতিয়া এলাকায় বছরজুড়ে থাকে জলাবদ্ধতা। সেখানে চলাচলের অন্যতম বাহন ডোঙা। গত শুক্রবার তোলাছবি: সাদ্দাম হোসেন

‘পানির রাজ্যে’ মানুষের টিকে থাকার লড়াই, কৃষক থেকে ডোঙার মাঝি

বিল ডাকাতিয়ায় একসময় ছিল সোনালি ধানের খেত, কচি সবজির চাষ আর কৃষকের হাঁকডাক। আজ সেখানে কোনো ধানখেত নেই; সবজির মাচাও নেই। এখন শুধু পানির রাজ্যে মানুষের টিকে থাকার লড়াই।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিলের অবস্থান। বিলের ভেতরেই উপজেলার রংপুর ইউনিয়নের শিয়ালদহ চাররাস্তার মোড়। পূর্বদিকে বটবেড়া, দক্ষিণে বারানসি, উত্তরে মুজারঘুটা আর পশ্চিমে কৃষ্ণনগর—সব গ্রামই পানির তলায়। মোড়ে এসে দাঁড়ালে বোঝা মুশকিল, সামনে পথ কোথায় মিলিয়ে গেছে। কালভার্ট পেরোতেই রাস্তা আর খালের ফারাক চোখে ধরা পড়ে না, একাকার হয়ে গেছে জল আর সড়ক।

উপায় না দেখে বসে পড়লাম খালের পাশের ছোট্ট দোকানে। দোকান চালান প্রভাতী মণ্ডল। তাঁর উঠোনও পানিতে তলিয়ে গেছে। গোয়ালে উঠেছে পানি। শুক্রবার ছুটির দিনে মায়ের পাশে বসে ছিল ছেলে বৃহঙ্গ মণ্ডল; পড়ে কৃষ্ণনগর স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে। এলাকা সম্পর্কে যেন মায়ের চেয়ে বেশি জানা বৃহঙ্গের। প্রতিদিনই ডোঙায় করেই স্কুলে যায় সে। স্কুলে গেলেই যাওয়া-আসায় খরচ ১০ টাকা।

প্রভাতী মণ্ডল বলেন, ও (বৃহঙ্গ) তো সাঁতার জানে না। মাঝিদের হাতে দিয়েই পাঠাই। কী করব? এখানে জীবন এ রকমই। এ রকম বাড়তি খরচ করতে পারলে কিছুটা পড়াশোনা চালানো যায়, না থাকলে যায় না।

চা শেষ হওয়ার আগেই চলে এলো একটি ডোঙা। দুপুরে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে উঠে পড়ি তাতে। কচুরিপানায় ভরা খালের সরু ফাঁক ধরে এগিয়ে চলি আমরা। কিছুক্ষণ পর নৌকার চলার পথ রাস্তার ওপর। অবাস্তব অথচ অমোঘ বাস্তবতা। কোথাও মাঝি নেমে ঠেলে দিচ্ছেন, কোথাও লগি হাতে সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছেন যাত্রীরা। কৃষ্ণনগরের কাটাখালের ছোট ছোট সাঁকো এখন পানির নিচে। আগে সাঁকোর নিচ দিয়ে গেলেও এখন সে উপায় নেই। নৌকা চালানোর সুবিধার জন্য তাই সাঁকোর মাঝখানের বাঁশ কেটে দেওয়া হয়েছে। চারপাশে পানির রাজত্ব। বাড়িঘর, রান্নাঘর, গোয়াল, সব নিমজ্জিত। কোমরপানি মাড়িয়ে নারীরা সংগ্রহ করছেন খাবার পানি।

সামনে যেতে ডোঙার আরেক দৃশ্যও চোখে পড়ে। সাজগোজ করা একদল নারী নিজ হাতে বৈঠা চালাচ্ছেন। একটি অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন তাঁরা। কেউ বৈঠা ধরে, কেউ কচুরিপানা সরিয়ে, কেউ আবার ডোঙার হাল ধরেছেন।

আমাদের মাঝি নকুল রায়। বয়স সত্তরের কোঠায়। একসময় ভাগে অন্যের জমি করতেন, নিজের বিঘাখানেক জমিতেও ফলাতেন ধান-সবজি। কিন্তু টানা দুই বছর চাষাবাদ বন্ধ। জমি আর চাষের উপায় নেই। বদলে গেছে জীবিকা। সংসারে আছেন স্ত্রী, ছেলে-বউমা, নাতি। ছেলে মাছ ধরে, আর নকুল চালান ডোঙা।

নকুল রায় ২০ হাজার টাকা খরচ করে কিনেছেন কাঠের ডোঙাটি। মাঝখানে পাঁচটি কাঠের পিঁড়ি নির্দিষ্ট দূরে দূরে সাজানো। মানে ডোঙায় যাত্রী ওঠানো যায় জনা পাঁচেক। এখানকার বেশির ভাগ পরিবারের ডোঙা আছে, তবে সেগুলো মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত থাকে। তাই নকুলদের ডোঙাই এখন ভরসা। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত গ্রামের মানুষ পারাপার করেন তাঁর ডোঙায়। বিদ্যালয়গামী শিশু, শিক্ষক, রোগী, বাজারগামী সবাই ডোঙার যাত্রী। দিনে নকুলের আয় হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।

ডোঙার যাত্রী বিজয় মণ্ডল বললেন, ‘এখন যে রাস্তার ওপরে নৌকা চলছে, এখানে কোথাও কোমরপানি, কোথাও গলা পর্যন্ত। এই রাস্তা দিয়ে শাহপুর-ফুলতলার দিকে যাওয়া যেত। নানা সংকটের মধ্যে বড় সংকট আমাদের রাস্তাটা। কাজ করতে করতে বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা শেষ হয় না।’

মাঝি আর যাত্রীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, খুলনার সবচেয়ে বড় উপজেলা ডুমুরিয়ার ১৪টির মধ্যে ৯টি ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশত গ্রামের মানুষ টানা তিন মাস পানিবন্দি হয়ে আছে। ভেসে গেছে ধানখেত, মাছের ঘের, সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্প ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

কৃষ্ণনগর স্কুলের পাশে এসে থামে নৌকা। স্কুল প্রাঙ্গণও ডুবে আছে। তবে এখানকার রাস্তা কিছুটা জেগে আছে। সেখানে নকুলের মতো আরও কয়েকজন ডোঙার মাঝি অপেক্ষা করছেন যাত্রীর আশায়।

তাঁদের একজন বিনয় মণ্ডল বললেন, ছোটবেলা থেকে জমি–জিরাতে কাজ করেছি। এখন ডোঙা চালাই। আগে বিলে জল আসত, কিছুদিন পর শুকাত। এখন দুই বছর ধরে শুকাচ্ছে না। হামকুড়া, হরি সব নদী মরে গেছে। স্লুইসগেটগুলো কাজ করে না। একমাত্র পথ শোলমারী নদীর স্লুইসগেটের সামনেও পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। বিল ডাকাতিয়ার জল আর বের হতে পারছে না।

অপেক্ষমাণ আরেকজন শচীন মণ্ডলের আক্ষেপ, ‘বড় বড় দলের বড়সড় নেতারা আসে, ভোট চায়। দেখে যায়, বলে “দেখপানে, হবেনে”। কিন্তু আমাদের বাঁচবার পথ কেউ দেখায় না।’

ফেরার পথে নকুল রায় ডোঙার হাল ধরে নিমগ্ন চেয়ে বললেন, ‘এই জলাবদ্ধতার জন্য মানুষই দায়ী। কিছু মানুষের জন্যই কিছু মানুষের বিপদ। আমরাই নদী মেরেছি, খাল নষ্ট করেছি। মানুষের লোভের শেষ নেই। প্রকৃতি তো প্রতিশোধ নেবেই।’

মাথার ওপর প্রখর রোদ। বিল ডাকাতিয়ার বুক চিরে এগিয়ে চলে তাঁর নৌকা। বৈঠার শব্দে মিশে থাকে জীবনের দীর্ঘশ্বাস—জলে ডোবা গ্রামে টিকে থাকার গান।