৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিত হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন

অবশেষে জাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা, কেনো এত সময় লাগলো?

ছবির উৎস, SCREEN GRAB

ভোট শেষ হওয়ার প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর ঘোষণা করা হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা জাকসু নির্বাচনের ফলাফল। যেখানে সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেলের আবদুর রশিদ জিতু। আর সাধারণ সম্পাদক পদে জিতেছেন সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের মাজহারুল ইসলাম।

যদিও ভোটের ফলাফল ছাপিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা জাকসু নির্বাচনে আলোচনার কেন্দ্রে ভোট গণনার দীর্ঘ সময়।

এবারের জাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ হাজার ৯১৯। ভোট গ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল, ৮ হাজার ১৬টি অর্থাৎ ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে।

তাই প্রশ্ন উঠেছে এই কম সংখ্যক ভোট গণনায় কেনো এতোটা সময় লাগলো?

জাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, কয়েকটি প্যানেলের দাবির প্রেক্ষিতে ওএমআর পদ্ধতিতে মেশিনে ভোট গণনার পরিবর্তে ম্যানুয়ালি বা হাতে ভোট গণনায় সময় বেশি লেগেছে।

"জাকসু নির্বাচনকে নিরপেক্ষ রাখতে সব পক্ষের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছি আমরা," বলেন তিনি।

এছাড়া অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগে নির্বাচনে অংশ নেয়া কয়েকটি প্যানেলের ভোট বর্জন এবং কয়েকজন শিক্ষকের ভোটের দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা রয়েছে।

যদিও ফল ঘোষণার আগে জাকসুর নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, "কিছু বিচ্যুতি থাকতে পারে কিন্তু ভোটে কোনো অনিয়ম হয়নি।"

গণনা পর্যায়ে ভোটের দায়েত্বে থাকা একজন শিক্ষকের মৃত্যু এবং অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ এনে কয়েকজন শিক্ষকের কমিশন থেকে পদত্যাগের ঘটনাও ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কিছুটা প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করে জাকসু নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া একাধিক গণমাধ্যমকর্মী।

তারা বলছেন, অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের এক পক্ষের ভোট বর্জন, অন্য পক্ষের ফল প্রকাশের দাবি, ভোটের দায়িত্ব থেকে কয়েকজন শিক্ষকের সরে দাড়ানো কিংবা এক শিক্ষকের মৃত্যু সব মিলিয়ে এবারের জাকসু নির্বাচনকে ঘটনাবহুলই বলা চলে।

ওএমআর মেশিনে ভোট গণনার কথা থাকলেও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ম্যানুয়ালি অর্থাৎ হাতে গোনা হয়।

ছবির উৎস, NAZMUL HUDA

জাকসু নির্বাচনের ভোট গণনা নিয়ে নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ওঠে

ছবির উৎস, NAZMUL HUDA

দীর্ঘ অপেক্ষার পর জাকসু নির্বাচনের ফলাফল

বিবিসি বাংলার সর্বশেষ খবর ও বিশ্লেষণ এখন সরাসরি আপনার ফোনে।

ফলো করুন, নোটিফিকেশন অন রাখুন

বিবিসি বাংলার সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা জাকসু নির্বাচনের ভোট গ্রহণের পর প্রায় ৪৬ ঘণ্টার অপেক্ষা।

অবশেষে শনিবার বিকেল সোয়া পাঁচটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন থেকে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়।

এসময় নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব অধ্যাপক রাশেদুল আলম জানান, নির্বাচনের ফলাফল ডিজিটাল পদ্ধতিতে করতে চাইলেও দুটি সংগঠন থেকে লিখিতভাবে এই ফলাফল ম্যানুয়ালি করার আবেদন জানানো হয়েছিল।

এছাড়া নির্বাচন নিয়ে ওঠা অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন মাধ্যমে নানা কথা বলা হলেও ভোটে কোনো অনিয়ম হয়নি, কিছু বিচ্যুতি হয়ে থাকতে পারে।"

এরপর শুরু হয় ফলাফল ঘোষণায় শুরুতেই ২১টি হল সংসদের ফল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তারপর ঘোষণা করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ২৫টি পদে নির্বাচিতদের নাম।

জাকসু নির্বাচনে সহ-সভাপতি বা ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেলের প্রার্থী আবদুর রশিদ জিতু। তিনি পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৩৪ ভোট।

আর সাধারণ সম্পাদক বা জিএস পদে ৩ হাজার ৯৩০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে শিবির সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম।

এছাড়া যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে ফেরদৌস আল হাসান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা নির্বাচিত হয়েছেন।

অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচন কমিশনের এক সদস্যও পদত্যাগ করেন

ছবির উৎস, NAZMUL HUDA

অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচন কমিশনের এক সদস্যও পদত্যাগ করেন

ছবির উৎস, NAZMUL HUDA

ফলাফল ঘোষণায় বিলম্ব কেনো?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা জাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ হাজার ৯১৯ জন। ভোট গ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশনের হিসেব অনুযায়ী, মোট ৮ হাজার ১৬টি অর্থাৎ ৬৭ দশমিক নয় শতাংশ ভোট কাস্ট হয়।

ধারণা করা হয়েছিল, এই ভোটের ফল ঘোষণা হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে নানা ঘটনাপ্রবাহে কেবলই বেড়েছে অপেক্ষা। কয়েক দফা সময় বাড়িয়েও বারবারই তা পরিবর্তন করেছে জাকসুর নির্বাচন কমিশন।

গত ১১ই সেপ্টেম্বর সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চলে জাকসু নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। ভোটার উপস্থিতি থাকায় দুটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হয় সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত।

এরপর আটটি কেন্দ্র থেকে ভোটের সরঞ্জামাদি নেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে স্থাপিত নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে। সব কেন্দ্র থেকে ভোটের ব্যালট ভর্তি বক্স পৌঁছানোর পর গণনা শুরু হতেই বেজে যায় রাত দশটা।

এর আগেই অবশ্য অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তুলে এই নির্বাচন বর্জন করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল।

সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে মিলে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অভিযোগ করেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক বা জিএস প্রার্থী তানজিলা হোসেন বৈশাখী।

তিনি দাবি করেন, "আমরা একটা ফ্রি-ফেয়ার ইলেকশন দাবি করেছি। কিন্তু ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, ভোটকেন্দ্রগুলো মনিটর করার জন্য জামায়াত নেতার কোম্পানিকে ক্যামেরা সাপ্লাই ও সিসিটিভির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।"

"জামায়াত নেতার কোম্পানি থেকেই ওএমআর মেশিন আনা হয়েছে। এর মাধ্যমে শিবিরের প্যানেলকে সুযোগ করে দেয়া হয়েছে," বলেও দাবি করেন তিনি।

অন্যদিকে ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের পাল্টা অভিযোগ তোলেন শিবির সমর্থিত, সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীরা।

এই প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক বা জিএস প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম দাবি করেন, "ওএমআর মেশিন যে প্রতিষ্ঠান থেকে আনা হয়েছে ওনার রাজনৈতিক পরিচয় আসলে বিএনপি ব্যাকগ্রাউন্ডের।"

এরপর পর্যায়ক্রমে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্প্রীতির ঐক্য ও সংশপ্তক পর্ষদসহ আরো চারটি প্যানেল।

প্রার্থীদের পাশাপাশি নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও দলীয় প্রভাবের অভিযোগ তুলে জাকসু নির্বাচনের দায়িত্ব থেকে সরে দাড়ানোর ঘোষণা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক শামীমা সুলতানা ও অধ্যাপক নাহরিন ইসলাম খান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই তিনজন শিক্ষকই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

এই সময়ের মধ্যে ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহ নির্বাচন বাতিলের শঙ্কাও তৈরি করে। তবে, নির্বাচনে অংশ নেয়া বাকি প্যানেলের প্রার্থীরা ফল প্রকাশের দাবিতে অবস্থান নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে।

ওএমআর মেশিনে ফলাফল গণনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় নির্বাচন কমিশনের কাছে, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে অর্থাৎ হাতেই ভোট গণনার দাবি জানান সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সংগঠক সোহাগী সামিয়া।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন একজন ভোটার।

ছবির উৎস, NAZMUL HUDA

বৃহস্পতিবার জাকসু নির্বাচনে ভোট দেন শিক্ষার্থীরা

ছবির উৎস, NAZMUL HUDA

এমন প্রেক্ষাপটে, জরুরি বৈঠকে বসে নির্বাচন কমিশন। যেখানে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে হাতে ভোট গণনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা জানান, বাতিল নয়, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে গণনার মাধ্যমে ঘোষণা করা হবে জাকসু নির্বাচনের ফলাফল। রাত দশটার দিকে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই শুরু হয় ভোট গণনা।

ভোট গণনা কার্যক্রমে অংশ নিতে এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে শুক্রবার সকালে মৃত্যু হয় জান্নাতুল ফেরদৌস নামে এক শিক্ষকের। যার মৃত্যু ঘিরে আবারও তৈরি হয় জটিলতা।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে নির্বাচন আয়োজনে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে শুক্রবার বিকেলে কার্যক্রম থেকে সরে দাড়ানোর ঘোষণা দেন কয়েকজন শিক্ষক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব ফয়জুন্নেসা হলের রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. সুলতানা আক্তার বলেন, "আমি আমার সহকর্মীর মৃত্যুতে ব্যথিত, ক্ষুব্ধ এবং আমার সহকর্মীর এই মৃত্যুর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবস্থাপনা দায়ী, নির্বাচন কমিশনের অব্যবস্থাপনা দায়ী, আমি এই মৃত্যুর বিচার চাই।"

তিনি বলেন, "আপনারা হাত দিয়েই যদি কাউন্টিং করাবেন তাহলে মেশিন কিনেছেন কেনো। তাহলে আগে থাকতেই বলতেন আমাদেরকে দিয়ে ভোট নেয়ালেন, আমাদেরকে দিয়ে যদি কাউন্টিংও করাতে হয় তাহলে হল থেকেই করাতেন।"

জানা যায়, প্রায় ২৪ ঘণ্টা পেরোলেও তখন পর্যন্ত জাকসু নির্বাচনের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভোট গণনাই শুরু হয়নি।

এমন পরিস্থিতিতে করণীয় ঠিক করতে শুক্রবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠকে বসেন জাকসুর নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা। অন্যদিকে সিনেট ভবনের সামনে আবারো অবস্থান নেন ফল প্রকাশের দাবি জানানো প্যানেলগুলোর শিক্ষার্থীরা।

বৈঠকের পর জানানো হয়, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে গণনা করেই জাকসুর চূড়ান্ত ফলাফল জানানো হবে। প্রয়োজনে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগের সিদ্ধান্তও নেয় নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে পদত্যাগের ঘোষণা দেন জাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তারও।

ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে ভোট গণনার কারণেই ফল প্রকাশে দেরি হয়েছে বলে দাবি করেন জাকসুর প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান।

তিনি বলছেন, হল ইউনিয়নের জন্য একটি ব্যালট পেপার আর কেন্দ্রীয় সংসদের জন্য তিনটি ব্যালট পেপার যেহেতু প্রার্থী ১৭৭ জন। সব মিলিয়ে এগুলো গণনা করতে আমাদের প্রচুর সময় লেগেছে।"