দ্বীপজেলা ভোলার মনপুরা উপজেলাসহ জেলার ২১টি দ্বীপচরে বাস করেন দুই লাখ জেলে। যারা সরাসরি মাছ ধরা পেশায় জড়িত। কিন্তু তারা জিম্মি হয়ে পড়েছেন দাদন ব্যবসায়ীদের বিশাল সিন্ডিকেটের কাছে। তাদের কাছ থেকে নেওয়া দাদনের (ঋণ) টাকায় জেলেদের নৌকা তৈরি ও জাল কিনতে হয়। বছরের পর বছর দাদন ব্যবসায়ীদের গদিতে (আড়তে) মাছ বিক্রি করেন তারা। কিন্তু শোধ হয় না ঋণ। দাদনের বেড়াজাল থেকে মুক্তি মেলে না। বরং নেমে আসে নির্মম নির্যাতন ও মৃত্যু। হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও বিচার পান না দরিদ্র জেলেরা।
জেলেদের ভাগ্যবদলে সুদমুক্ত দাদনের কথা মাইকে প্রচার করতে গিয়ে চরনিজামে প্রকাশ্যে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন হাজি আবু তাহের, ইউছুফ দালাল, আলম সিরাং ও জাহানারা বেগম। ২০০৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে হাজারো জেলের সামনে নির্মম হত্যাকাণ্ড হলেও তারা প্রতিবাদ জানাতে পারেননি। গেল ২২ বছরেও বিচার পায়নি ওই চার পরিবার। নদী ও উপকূলের জীবন যেন নদীর ভাঙনের মতো হারিয়ে যায়।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ রাজিয়া বেগম জানান, তার স্বামী আবু তাহের ছিলেন সাধারণ জেলেদের আপনজন। মাছ ধরার পেশায় থাকা অবস্থায় জেলেদের সব সময় উপকার করতেন। জেলেদের সঙ্গে পরামর্শ করে ২০০৩ সালে চরনিজাম মাছঘাট ইজারা নেন আবু তাহের। এরপরই নদীতে মাইকিং করে ঘোষণা দেন, এখন থেকে ঘাটে কারও কর দিতে হবে না। দানের জন্য সুদ দিতে হবে না। জলদস্যুদের একজোটে মোকাবিলা করা হবে। এমন ঘোষণায় হাজারো জেলে আবু তাহেরকে সমর্থন জানিয়ে তার ঘাটে ভিড় জমাতে থাকেন। এটি মেনে নিতে পারেনি দীর্ঘদিন জেলেদের শোষণ করা দাদন ব্যবসায়ীরা। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে আবু তাহের ও তার ঘনিষ্ঠদের নির্মমভাবে হত্যা করে।
ইউছুফ দালালের স্ত্রী রাবেয়া বেগম জানান, চরনিজামের মাছঘাটের পাশে সরকারি গুচ্ছগ্রামে বাস করতেন তারা। তার স্বামীও জেলেদের অতি আপনজন ছিলেন। হাজি তাহেরের ঘোষণার সময় ওই ট্রলারে তার স্বামীও ছিলেন। তাকেও কুপিয়ে, শরীরে লবণ-মরিচ মেখে, বরফচাপা দিয়ে নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। ওইদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হামলায় নিহত জাহানারা বেগমের মেয়ে তাছনুর বেগম জানান, তিনি এই নৃশংস নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা দেখেছেন। তাদের বাড়ি চরনিজামের পাশে লতাখালি এলাকায়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মন্নান মিয়ার নির্দেশে তার পালিত লোকজন ১৭টি ট্রলার নিয়ে আবু তাহেরকে ধাওয়া দেয়। আবু তাহের লতাখালি ঘাটে ট্রলার ভিড়িয়ে দৌড়ে জাহানারা বেগমের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ওই ঘর থেকে তাকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। তাসনুরের মা জাহানারা বেগম আবু তাহেরকে বাঁচাতে ছুটে যান। তাকেও হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের সময় ১২ বছরের শিশু মো. হাসান মেহেদীর বয়স এখন ৩৪ বছর। যুগান্তরের কাছে বাবা হারানোর বেদনা ও দীর্ঘ সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
জেলেদের শোষণের চিত্র : ভোলার মদনপুর চরে ও মাঝের চরে গেল ৩০ বছরে মাছঘাট দখল নিয়ে হামলা ও হত্যার ঘটনা রয়েছে শতাধিক। মাছ ব্যবসয়ীদের দ্বন্দ্বে নিহত হন সাধারণ জেলেরা। ভোলার কাঠিরমাথা ঘাট, ভোলার খাল, জোরখাল, ইলিশাঘাট, দৌলতখানের চৌকিঘাট, তজুমদ্দিনের একাধিক মাছঘাট, চরফ্যাশনের সামরাজঘাট, মনপুরার কলাতলির ঘাট, সাকুয়াঘাট রামনেওয়াজ ঘাট, কোড়ালিয়াঘাট, চরফ্যাশনের সামরাজঘাট, ঢালচরঘাটসহ নদী ও সাগরমোহনায় রয়েছে ১২২টি মাছঘাট। এসব ঘাটেই প্রভাবশালীদের দাদন ব্যবসা রয়েছে। তাদের শতকোটি টাকার বিনিয়োগের বিপরীতে ২ লাখ জেলেকে জিম্মি করে রাখার নজির ৫০ বছরের। দুর্ঘটনায় জেলে নিহত বা আহত হলে মেলে না কোনো সাহায্য। জেলেদের সুবিধা দিতে আজও গড়ে ওঠেনি মৎস্যব্যাংক ও সরকারি সুবিধা। ফলে জেলেরা প্রভাবশালীদের কাছ থেকে দানের নামে ঋণ নিতে বাধ্য হন। নদীতে নেই জেলেদের নিরাপত্তা। নৌপুলিশের টহলের নামেও রয়েছে নানা অভিযোগ। রয়েছে জলদুস্যদের দৌরাত্ম্য। প্রভাবশালী দাদন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জলদস্যুদের নেটওয়ার্ক থাকারও অভিযোগ রয়েছে। ওই দস্যুরা নিরীহ জেলেদের মাছ লুট করে ফের তার নেটওয়ার্কের ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে। আবার কোনো জেলে কোনো গদিতে মাছ না দিলে জলদস্যু দিয়ে তাদের ওপর হামলা করা হয়। স্পিডবোটে নিরীহ জেলেদের ধরে এনে প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়ার নজির রয়েছে মদনপুর ঘাটে।
জেলের পরিসংখ্যান : ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, জেলায় নদী ও সাগরে মাছ ধরা ও বিক্রির কাজে রয়েছেন ২ লাখ জেলে। এর মধ্যে ১ লাখ ৭০ হাজার জন নিবন্ধনের আওতায় এসেছেন। জাটকা রক্ষা প্রকল্পের আওতায় বছরে ৪ মাসের জন্য নিবন্ধিত জেলেদের মধ্যে ৮৯ হাজার ৬০০ পরিবারকে ৪ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। অপরদিকে সাগরগামী জেলে রয়েছেন ৬৫ হাজার। এর মধ্যে ৬৩ হাজার ৯৫৪ জন জেলে পরিবারকে ৫৪ দিনের জন্য ৮০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। সরকারিভাবে জেলেদের স্বাবলম্বী করতে ৩০০ বকনা গরু দেওয়া হলেও এই সুবিধা বেশির ভাগ জেলে পাননি। এমন অভিযোগ রয়েছে। বিগত দিনে দলীয় কর্মীরাই এসব সুবিধা ছিনিয়ে নিয়েছেন বলে জেলেদের অভিযোগ।
ইলিশ রক্ষা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোল্লাহ এমদাত উল্লাহ জানান, তিনি ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় জেলেদের ওপর শোষণ দেখেছেন, জেলেদের নির্যাতনের শিকার হতে দেখেছেন। মাছ ধরা নিষিদ্ধ সময়ে প্রভাবশালী একটি চক্র জেলেদের নদীতে নামতে বাধ্য করত। তাই জেলেদের নিরাপত্তাসহ তাদের স্বাবলম্বী করতে মৎস্য অধিদপ্তর বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে।