জনদুর্ভোগের আন্দোলনে নাভিশ্বাস বরিশালে

জনদুর্ভোগের আন্দোলনে নাভিশ্বাস বরিশালে

প্রতিদিন ১-২ ঘণ্টা করে বন্ধ রাখা হচ্ছে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক। তিন দফা দাবি আদায়ে টানা চার দিন ধরে রুটিন করে এই সড়ক অবরোধ করছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর আগে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার দাবির আন্দোলনে পরপর ৯ দিন অবরোধ করে রাখা হয়েছিল একই মহাসড়ক। ঢাকা-ভোলা মহাসড়কেও ঘটছে একই ঘটনা। আন্দোলনের নামে এভাবে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধে একদিকে যেমন দুর্ভোগে পড়ছে মানুষ তেমনি স্থবির হয়ে পড়ছে অর্থনীতির চাকা। এক হিসাবে দেখা গেছে, গড়ে ৩ ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকলে কেবল মৎস্য খাতেই ৪০-৪৫ কোটি টাকা ক্ষতির শিকার হয় দক্ষিণ উপকূল। সেইসঙ্গে রয়েছে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়াসহ শিল্প এবং কৃষি সেক্টরের অপূরণীয় লোকসান।

সারা দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত সংস্কারের দাবিতে ছাত্র-জনতার ব্যানারে ২৮ জুলাই থেকে বরিশালে শুরু হয় রাজপথের আন্দোলন। এতে মুখ্য সংগঠকের ভূমিকায় ছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পরিচিত মুখ মহিউদ্দিন রনি। প্রথম দিকে সমাবেশ মিছিলে সীমাবদ্ধ থাকা এই আন্দোলন ৭ আগস্ট গিয়ে ওঠে নগরীর নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কে। শুরু হয় তাদের মহাসড়ক অবরোধ পর্ব। ১৫ আগস্ট পর্যন্ত চলা এই আন্দোলনে ৯ দিন ঢাকা থেকে কুয়াকাটাসহ দক্ষিণের ৬ জেলাগামী যানবাহনগুলো আটকে ছিল নথুল্লাবাদ পয়েন্টে। দাবি আদায়ে মহাসড়ক অবরোধের মতো জন-দুর্ভোগের কর্মসূচি প্রসঙ্গে আন্দোলনের মুখপাত্র কাজী জায়েদ বলেন, ‘আমরা তো শুরুতে ১১ দিন শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন-সমাবেশ করেছি। কিন্তু কেউ কান দেয়নি। মহাসড়ক অবরোধের পর দেখলাম সবার টনক নড়ল। শুরুতেই আমাদের দাবির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হলে তো মহাসড়ক অবরোধের মতো কঠিন কর্মসূচিতে যেতে হতো না।’

এ আন্দোলন স্তিমিত না হতেই মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচিতে নামেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অবকাঠামোগত সংকট দূরসহ তিন দফা দাবিতে সপ্তাহখানেক আগে শুরু হওয়া এ আন্দোলনও গড়িয়েছে মহাসড়কে। রোববার থেকে রুটিন করে বন্ধ রাখা হচ্ছে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক। প্রতিদিন দুপুরে দেড় থেকে ২ ঘণ্টা এ সড়ক অবরোধ নিয়ে এরই মধ্যে নানা অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মহাসড়ক অবরোধের এ ঘটনা অবশ্য অনেকটাই নিত্যনৈমিত্তিক। আন্দোলনের ভাষা হিসাবে মহাসড়ক অবরোধ বিষয়ে তাদের বক্তব্যও অনেকটাই স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার আন্দোলনের মতোই। এসব আন্দোলনের আগে দাবি আদায়ে তিন দিন ঢাকা-ভোলা মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছিলেন বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীরা। গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের ওপর হামলার খবরে তাৎক্ষণিক অবরোধ করা হয় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক। একই ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামে এনসিপির সমাবেশ মঞ্চ ভাঙচুরের প্রতিবাদে। ক্যাম্পাসের নানা দাবি আদায়ে দুদিন নগরের অভ্যন্তরে থাকা নতুন বাজার সড়ক অবরোধ করে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা। গত সপ্তাহে অবরোধ করা হয় নগর ভবনসংলগ্ন ফজলুল হক এভিনিউ ও ব্যস্ততম সদর রোড।

মঙ্গলবার বিকালেও অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আয়তন বৃদ্ধি এবং নিরাপদ পরিবহণ ব্যবস্থা নিশ্চিতের দাবিতে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষার্থীরা। বিকাল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত তারা ববির মূল গেটের সামনের মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এ সময় মহাসড়কের দুপ্রান্তে অসংখ্য যানবাহন আটকা পড়ে ভয়াবহ যানজটে ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ যাত্রীরা।

এক হিসাবে দেখা গেছে, গত এক মাসে ২৭ দিন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কসহ দক্ষিণের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করা হয়েছে। এসব আন্দোলনে যুক্ত ছিল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্র-জনতার ব্যানারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বরিশাল বিএম কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট এবং নার্সিং ইনস্টিটিউট। এদের মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের আন্দোলন এখনো চলমান আর মহাসড়ক অবরোধের দৈনিক কর্মসূচিতে চলছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। আন্দোলনের ভাষা হিসাবে মহাসড়ক অবরোধের ব্যাখ্যায় আন্দোলনকারী প্রায় সবার সেই একই বক্তব্য, এটা না করলে দাবির আওয়াজ সরকারের কানে পৌঁছায় না।’

আন্দোলনের নামে মহাসড়ক অবরোধের এসব ঘটনায় একদিকে যেমন দুর্ভোগে পড়েন হাজার হাজার মানুষ তেমনি ব্যাপক ক্ষতি হয় অর্থনীতির। বরগুনা জেলা মৎস্য ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘দক্ষিণ উপকূলের অর্থনীতির বিশাল একটি অংশ মৎস্যনির্ভর। বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলাসহ উপকূলীয় এলাকা থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মাছ যায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। পচনশীল এই পণ্য যখন অবরোধে ৭-৮ ঘণ্টা আটকে থাকে তখন আর এর বাজারমূল্য থাকে না। আমরা যদি কেবল ঘণ্টার হিসাব ধরি তাহলে প্রতি ঘণ্টার অবরোধে মৎস্য সেক্টরে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।’

বরিশাল মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’র প্রেসিডেন্ট নিজামউদ্দিন বলেন, ‘টানা ৮-৯ ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকলে যে ক্ষতি হয়, তা টাকার অংকে পরিমাপ করা কঠিন। মানুষের কর্মঘণ্টা, নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারার ফলে যানবাহনের শিডিউল বিপর্যয়, বিভিন্ন কাঁচা পণ্যের ক্ষতি এবং যথাসময়ে পণ্য পৌঁছাতে না পারায় নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ ক্ষতির এই অংকটা শতকোটি টাকা।’ ঢাকাস্থ বরিশাল জেলা সমিতির সভাপতি প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের পর থেকেই যেন মানুষ সব দাবি একসঙ্গে আদায়ের লড়াইয়ে নেমেছে। এই লড়াইয়ের একমাত্র ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ। অবাক হয়ে দেখি, ৩০-৪০ জন মিলে হাজার হাজার মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথে আটকে রাখছে। এটা তো আন্দোলনের কোনো ভাষা হতে পারে না। আমি মনে করি, দাবি আদায়ের ভিন্ন কোনো পথ খুঁজে বের করা উচিত। নয়তো দেখা যাবে গণবিরোধিতার মুখে মানববন্ধন-হরতালের মতো এটিও একসময় আন্দোলনের ভোঁতা অস্ত্রে পরিণত হবে।’