কামরুল হাসান রাব্বি সিলেট সদর উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা। নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের এ সক্রিয় কর্মী জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর হামলায় সরাসরি জড়িত ছিলেন। একপর্যায়ে পালিয়ে শাহরাস্তিতে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যার আগে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে শাহরাস্তি পৌর মেয়র আব্দুল লতিফের বাসায় হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটে গিয়ে আহত হন তিনি। ওই আহতের সূত্রধরে তিনি জুলাই যোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত হয়েছেন (গেজেট নং ৯২০)।
মো. রায়হান নামে একজন দাবি করেছেন, তিনি ৪ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন। পরদিন তিনি শাহরাস্তির চিতোষী আইডিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। অথচ হাসপাতালটি সরকার পতনের দুই বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে কিভাবে তিনি ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেন এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো এই রায়হানও জুলাই যোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত হয়েছেন (গেজেট নং ৯৩৯)।
রাব্বি ও রায়হানদের মতো এমন অনেকেই শাহরাস্তিতে জুলাই যোদ্ধা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন যাদের অভ্যুত্থানে কোনো ভূমিকা নেই বরং তারা বিরোধী ছিলেন। এ নিয়ে প্রকৃত জুলাই যোদ্ধাদের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের উত্তাল জুলাই আন্দোলনে চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে বড় ধরনের সহিংসতা হয়নি। সম্প্রতি প্রকাশিত সরকারি গেজেটে এ উপজেলার ২৮ জনকে আহত হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সরেজমিন অনুসন্ধান ও আন্দোলনকারীদের বক্তব্যে দেখা গেছে, তালিকায় অন্তর্ভুক্ত অনেকের নাম ও তথ্যে গরমিল রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, কেউ বন্ধ হাসপাতালের চিকিৎসা দেখিয়ে নাম তুলেছেন, কেউ পূর্বের মানসিক সমস্যাকে আন্দোলনে আহত দেখিয়েছেন, আবার কেউ নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মী হয়েও ‘আহত জুলাই যোদ্ধা’ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো ৫ আগস্টে লুটপাটে গিয়ে আহত হয়েও জুলাই যোদ্ধা বনে গেছেন কেউ কেউ।
জুলাই যোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত মো. ইউছুব আলী (গেজেট নং ৯২২) দাবি করেছেন, ৫ আগস্ট কালিয়াপাড়ায় তিনি আন্দোলনে বাঁশের আঘাতে গুরুতর আহত হন। ওই আহত দেখিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে এক লাখ টাকার চেকও পেয়েছেন তিনি। কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ওইদিন কালিয়াপাড়ায় কোনো সংঘর্ষ ঘটেনি। আরেক জুলাই যোদ্ধা নাহিদুল ইসলাম রাতুল (গেজেট নং ১০৪৪) আন্দোলনে মাথায় আঘাত পেয়ে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি ছোটবেলা থেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তারপরও তিনি সরকারি সহায়তা পেয়েছেন।
গেজেট নং ২০১৩-এর শাহজালাল দাবি করেছেন, ২ আগস্ট কাচ ভাঙার আঘাতে আহত হয়ে ৩ আগস্ট শাহরাস্তি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। কিন্তু হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ওইদিন এ ধরনের কোনো রোগী সেখানে চিকিৎসা নেননি।
এদিকে এসডিএফ (সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন) থেকে শাহরাস্তিতে ১১ জনকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নাজমুল হাসানের পরিবারকে ‘জুলাই আন্দোলনে নিহত’ দেখিয়ে দুই লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়। অথচ স্থানীয়দের মতে, নাজমুল গত ২৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের একটি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে মারা যান। লাশ উদ্ধার সম্ভব হয়নি। তার মৃত্যুর দাবিটি নিশ্চিত না হলেও তাকে জুলাই যোদ্ধা দাবি করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সহায়তা পাওয়া সব ব্যক্তিই ওই এনজিওর সদস্য এবং সুবিধাভোগী। এ বিষয়ে এসডিএফ শাহরাস্তি শাখায় যোগাযোগ করা হলে তারা জানান এটি একটি প্রকল্প। খিলাবাজার শাখায় গেলে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। খিলাবাজার শাখায় গিয়ে সেখানে তাদের কার্যালয় তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে। সেখানে ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কোনো কর্মকর্তার দেখা মেলেনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আব্দুল কাইয়ুম মাহিন বলেন, আন্দোলনের সময় আমরা রাজপথে ছিলাম। অথচ গেজেটে যাদের নাম এসেছে তাদের অধিকাংশকেই আমরা চিনি না। অনেকে ভুয়া তথ্য দিয়ে সরকারি সহায়তা নিয়েছে। অবিলম্বে ভুয়া নাম বাতিল করে প্রকৃত আহতদের অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আক্তার হোসেন শিহাব বলেন, আমি আন্দোলনে আহত হয়েছি। কিন্তু তালিকায় প্রকৃত আহতদের বাদ দিয়ে অচেনা নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রশাসনের উচিত ভুয়াদের বাদ দেওয়া। শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিয়া হোসেন বলেন, আমরা ইতোমধ্যে পাঁচজনের নাম গেজেট থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছি। প্রয়োজনে আরও যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।