বন্দুক হাতে পাকিস্তানের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব ফরেস্ট ইউসুফ এস আহমেদছবি: তাঁর লেখা বই ‘উইথ দ্য ওয়াইল্ড অ্যানিমেলস অব বেঙ্গল’ থেকে নেওয়া।

এক বন কর্মকর্তার লেখায় রাঙামাটির জঙ্গলে বাঘ দেখার অভিজ্ঞতা

মাচায় গুলি ও বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত দুই কর্মকর্তা। পাহাড়ি জঙ্গলের দিকে তীক্ষ্ণ নজর। কখন আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত শিকার। প্রবল পরাক্রমশালী সেই শিকারকে ঘায়েল করার জন্য মুখিয়ে আছেন দুই শিকারি। নিজেদের মধ্যে টানটান উত্তেজনা। এলাকার মানুষের অপেক্ষার প্রহরও যেন শেষ হচ্ছে না। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। সূর্য প্রায় অস্ত যাচ্ছে। ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল কাঙ্ক্ষিত শিকার—বাঘিনী। একই দিক থেকে দুলকি চালে বের হয়ে এল বাঘের বাচ্চা। পৌঁছে গেল মায়ের কাছে। খেলতে খেলতে ১৫ মিনিট ধরে দুধ পান করল।

বাঘ শিকারে গিয়ে ৭৫ বছর আগে এমন অভাবনীয় দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন বন কর্মকর্তা ইউসুফ এস আহমেদ। যিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব ফরেস্ট ছিলেন। চাকরি জীবনে রাঙামাটির জঙ্গলে বাঘের সঙ্গে দেখা হওয়া এবং শিকার করতে গিয়ে কী হয়েছিল তা তুলে ধরেছিলেন নিজের লেখা ‘উইথ দ্য ওয়াইল্ড অ্যানিমেলস অব বেঙ্গল’ বইয়ে।

ইউসুফ এস আহমেদ ১৯২৬ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বেঙ্গল প্রভিন্সের বিভিন্ন বনে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দেশভাগের পর ১৯৫৯ সালে বন বিভাগের চাকরি থেকে অবসরে যান তিনি। এই ৩৩ বছরে বনজঙ্গলে সময় কাটানো এবং বন্য প্রাণীর সঙ্গে একে একে ঘটে যাওয়া রোমাঞ্চকর সব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন তাঁর বইয়ে।

দুই বাংলার অরণ্যে এক বন কর্মকর্তার রোমাঞ্চকর অভিযান নিয়ে লেখা এই বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালের জুলাই মাসে। আর ইংরেজিতে লেখা এই বইয়ের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে চলতি বছরের বইমেলায়। কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত এই বই অনুবাদ করেছেন গণমাধ্যমকর্মী ও অনুবাদক ইশতিয়াক হাসান।

সুন্দরবন ছড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়েও একসময় ছিল বেঙ্গল টাইগারের বিচরণ। সুন্দরবনে এখনো বাঘের দেখা মিললেও পাহাড়ে প্রবল পরাক্রমশালী এই প্রাণীর সাক্ষাৎ পাওয়া যাচ্ছে না দীর্ঘদিন। তবে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা সরকারি কর্মকর্তারা পাহাড়ে দেখা পেয়েছিলেন বাঘের। নিজেদের কর্মজীবন নিয়ে লেখা বইয়ে, স্মৃতিকথায় তুলে ধরেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে বাঘের উপস্থিতি। বিবরণ দিয়েছেন বনে-পাহাড়ে বাঘের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তও।

সুন্দরবন ছাড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়েও একসময় ছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বিচরণ। সুন্দরবনে এখনো বাঘের দেখা মিললেও পাহাড়ে প্রবল পরাক্রমশালী এই প্রাণীর সাক্ষাৎ পাওয়া যাচ্ছে না দীর্ঘদিন। তবে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা সরকারি কর্মকর্তারা পাহাড়ে দেখা পেয়েছিলেন বাঘের। নিজেদের কর্মজীবন নিয়ে লেখা বইয়ে, স্মৃতিকথায় তুলে ধরেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে বাঘের উপস্থিতি। বিবরণ দিয়েছেন বনে-পাহাড়ে বাঘের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তও।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব ফরেস্টের দায়িত্ব পালন করা ইউসুফ এস আহমেদের পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে ২৮ বছরের কর্মজীবনের সম্পর্ক ছিল। চাকরিসূত্রে বাংলাদেশ-ভারতের অনেক বনজঙ্গলে সময় কাটিয়েছেন তিনি। দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন এবং আগ্রহের কারণে ছুটে গিয়েছিলেন দেশের নানা প্রান্তের বনে-জঙ্গলে। মুখোমুখি হয়েছেন নানা বিচিত্র-বৈচিত্র্যময় ঘটনার। আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন বাঘ ও হাতির। কিন্তু দীর্ঘ কর্মজীবনে মাত্র একবারই বাঘের দেখা পেয়েছিলেন বলে জানান ইউসুফ এস আহমেদ। নিজের জবানিতে তিনি লেখেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের কাসালং সংরক্ষিত বনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল ১৯৩০ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৮ বছরের। কিন্তু এতগুলো বছরে আমি সেখানে বাঘের দেখা পেয়েছি কেবল একবার।’

মাত্র একবার দেখা পেলেও সে ঘটনাটি ছিল অনন্য। ‘সময়টা ছিল ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাস। কাসালং নদীতে তখনো বেশ পানি ছিল। একটি ইঞ্জিনচালিত লঞ্চে ভ্রমণ করছিলাম। এখনকার বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান। আমি তখন ছিলাম কনজারভেটর অব ফরেস্ট বা বন সংরক্ষক। সেই সঙ্গে ছিলাম পূর্ব পাকিস্তান বন বিভাগের প্রধান। ঢাকা থেকে অল্প সময়ের জন্য এসেছিলাম। প্রথমে ট্রেনে আসি চট্টগ্রাম। তারপর জিপ চেপে রাঙামাটি এসে একটি মোটর লঞ্চে রওনা দিই মাইনিমুখের উদ্দেশে।’

মাইনি এবং কাসালং নদী যেখানে মিলিত হয়েছে, তার কাছেই ছিল বন বিভাগের অফিস। সেখান থেকে পশ্চিমে প্রায় ২০০ গজ দূরে ছোট একটি পাহাড়ের ওপর একাকী দাঁড়িয়ে ছিল ফরেস্ট রেস্ট হাউসটি।

বাংলোতে রাত কাটিয়ে শিলকের জঙ্গলে গিয়েছিলেন ইউসুফ আহমেদ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে। সেখানে অবস্থান করার সময় দুপুরে এক উত্তেজনাকর খবর পান তিনি। তাঁকে জানানো হয়, আগের দিন সন্ধ্যায় এক বাঘিনী স্থানীয় স্কুলের খেলার মাঠে একটি গরু মেরেছে। বাঘিনীকে নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন বাঘিনীকে মারার জন্য বন কর্মকর্তাকেই অনুরোধ করেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব ফরেস্টের দায়িত্ব পালন করা ইউসুফ এস আহমেদের পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে ২৮ বছরের কর্মজীবনের সম্পর্ক ছিল। চাকরি সূত্রে বাংলাদেশ-ভারতের অনেক বনে-জঙ্গলে সময় কাটিয়েছেন তিনি। দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন এবং আগ্রহের কারণে ছুটে গিয়েছিলেন দেশের নানা প্রান্তের বনে-জঙ্গলে। মুখোমুখি হয়েছেন নানা বিচিত্র-বৈচিত্র্যময় ঘটনার। আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন বাঘ ও হাতির। কিন্তু দীর্ঘ কর্মজীবনে মাত্র একবারই বাঘের দেখা পেয়েছিলেন বলে জানান লেখক ইউসুফ এস আহমেদ। নিজের জবানিতে তিনি লেখেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের কাসালং সংরক্ষিত বনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল ১৯৩০ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৮ বছরের; কিন্তু এতগুলো বছরে আমি সেখানে বাঘের দেখা পেয়েছি কেবল একবার।’

বাঘিনীকে শিকারের জন্য স্থানীয় মানুষের অনুরোধের কথা বইয়ে উল্লেখ করেন ইউসুফ এস আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বাঘিনীটি মারায় আমার আগ্রহ ছিল না মোটেই। তারপরেও অনুরোধের ঢেঁকি গিলে সেখানে পৌঁছে মাচায় চড়ে বসলাম। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে শুরু হলো মুষলধারায় বৃষ্টি। সৌভাগ্যক্রমে আমার নেপালি বেয়ারা আমার নিষেধ সত্ত্বেও একরকম জোর করেই আমাকে ফিরিয়ে নিতে একটি হাতি পাঠিয়ে দিয়েছিল। এতে জলে ভিজে জ্বর হওয়া থেকে বেঁচে গেলাম।’

পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে আবার জঙ্গলে যাওয়ার পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন ইউসুফ এস আহমেদ। এর মধ্যে খবর আসে, মরা গরুটিকে নিয়ে আরও পশ্চিমে গেছে বাঘিনী। এবার রেখেছে নালার ধারে। আগের পরিত্যক্ত জুম থেকে ১০০ গজ দূরে। সেখানে দুটি মাচা বাঁধা হয়েছে। যেখানে মৃত গরুটি রাখা হয়েছে একটি মাচা তার কাছাকাছি, আরেকটি নালার জলে ভরা গর্তের কাছে।

বাঘিনীটি মারায় আমার আগ্রহ ছিল না মোটেও। তার পরও অনুরোধের ঢেঁকি গিলে সেখানে পৌঁছে মাচায় চড়ে বসলাম। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে শুরু হলো মুষলধারায় বৃষ্টি। সৌভাগ্যক্রমে আমার নেপালি বেয়ারা আমার নিষেধ সত্ত্বেও একরকম জোর করেই আমাকে ফিরিয়ে নিতে একটি হাতি পাঠিয়ে দিয়েছিল। এতে জলে ভিজে জ্বর হওয়া থেকে বেঁচে গেলাম।’
ইউসুফ এস আহমেদ, সাবেক বন কর্মকর্তা ও লেখক

একটি মাচায় বসলেন বিভাগীয় বন সংরক্ষক, আরেকটিতে ইউসুফ এস আহমেদ নিজেই। দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। সন্ধ্যা প্রায় আসন্ন। ঠিক এ রকম একটি মুহূর্তে জঙ্গল থেকে বের হয়ে এল পূর্ণবয়স্ক বাঘিনী। এসে কোনো হুংকার ছাড়ল না এই বন্য প্রাণী। অনেকটা বিড়ালের মতো মিউ মিউ করতে লাগল। একই দিকের গুল্মের অন্য একটি জঙ্গলের ভেতর থেকে একটি বাঘের বাচ্চা বের হয়ে দুলকি চালে মায়ের কাছে পৌঁছে গেল। সন্তানকে দেখে এবার একপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল বাঘিনী। তার স্তনের বোঁটাগুলো উন্মুক্ত হয়ে গেল এতে। খেলতে খেলতে ১৫ মিনিট ধরে দুধ পান করল বাচ্চাটি।

শিশু ও মায়ের এমন আনন্দময় দৃশ্য কোমল করে ইউসুফ এস আহমেদের হৃদয়কেও। বাঘিনীকে এই এলাকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা হয় তাঁর। তবে বাঘিনীকে গুলি করার সংকেত দেন বন কর্মকর্তা। তিনি নিজেই তো করলেন না, ওই বন কর্মকর্তাকেও নিষেধ করেন গুলি করতে। কিন্তু অধৈর্য হয়ে তাঁর সঙ্গী ধীরে ধীরে রাইফেল তুলছিলেন গুলি করার জন্য। এ অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যান তিনি। তাই দ্রুত বাঘিনীর গায়ে যাতে না লাগে সে জন্য ফাঁকা গুলি করেন। তাতে মা ও বাচ্চা দুটিই লাফ দিয়ে জঙ্গলে চলে যায়। আর খুশিমনে তিনি ফিরে যান বাংলোয়।

এরপর ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন। তাঁর ধারণা ও আশা ছিল বাঘিনী এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু পরে জেনেছিলেন, বাঘিনীকে আর রক্ষা করা যায়নি। একদিন চাকমাদের পাড়ায় ঢুকে খোঁয়াড় থেকে একটি গরু ধরে মেরে ফেলে ওই বাঘিনী। গরুটির মালিক স্থানীয়ভাবে বানানো মদ খেয়ে নেশার ঘোরে ছিলেন। রাগে-ক্ষোভে ওই লোক বাঘিনী যে গুহায় থাকত, সেখানে হাজির হয়ে যান। আর এক গুলিতে মেরে ফেলেন প্রাণীটিকে।

ইউসুফ এস আহমেদের ভাষায়, ‘এভাবেই মাইনিমুখের বাঘিনীর করুণ পরিণতি নিশ্চিত হলো। সেই সঙ্গে মাহারা হলো বাচ্চাটি।’