চট্টগ্রামে কোকেন উদ্ধারের মামলায় চার বিদেশি নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র
নাইজেরিয়ার নাগরিক আফিজ ওয়াহাব ও ইকেচুকু এনওয়াগউ। থাকতেন ঢাকার খিলক্ষেতের নামাপাড়ায়। বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলতেন ফুটবল। এরই ফাঁকে জড়িয়ে যান মাদক পাচারের আন্তর্জাতিক চক্রে। ফুটবল খেলোয়াড় পরিচয়ের আড়ালে শুরু করেন কোকেন পাচার। দুই বছর আগে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় চার কেজি কোকেন জব্দের ঘটনার তদন্তে উঠে এসেছে এ তথ্য।
কোকেন উদ্ধারের এ মামলায় গত আগস্ট মাসের শেষ দিকে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। অভিযোগপত্রে এই দুই ফুটবলার ছাড়াও আরও দুই বিদেশি নাগরিককে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের একজন জ্যাকব ফ্রাঙ্ক ওরফে ডন ফ্রাঙ্কি। জন লেরি নামেও পরিচিত তিনি। তাঁর বাড়ি নাইজেরিয়ার এনগু প্রদেশে। অপরজন হলেন বাহামা দ্বীপপুঞ্জের গ্র্যান্ড বাহামা দ্বীপের নাগরিক স্ট্যাশিয়া শ্যান্টিয়া রোল। তাঁর কাছ থেকেই বিমানবন্দরে কোকেন জব্দ করা হয়। চারজনের মধ্যে জ্যাকব ফ্রাঙ্ক ছাড়া অন্য তিনজন চট্টগ্রামে কারাগারে রয়েছেন।
আফিজ ওয়াহাব এক বাংলাদেশি নারীকে বিয়ে করেছেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি ফেনী ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলেন। তাঁর ভিসা ২০১২-২০১৩ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। এর আগেও তিনি একই কারণে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ইকেচুকু ফুটবল খেলতেন বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের সাবেক পরিদর্শক লোকাশীষ চাকমা বর্তমানে কক্সবাজারে কর্মরত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আদালতে অভিযোগপত্রটি জমা দেওয়া হয়েছে। তবে অভিযোগপত্র গ্রহণের শুনানির তারিখ এখনো জানা যায়নি।
লোকাশীষ চাকমা বলেন, জ্যাকব ফ্রাঙ্ক দীর্ঘদিন বাংলাদেশে ছিলেন। দুই বছর আগে নাইজেরিয়া চলে যান। সেখানে বসে কোকেনের চালানটি ব্রাজিল থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা এবং এখান থেকে ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা—সবকিছুই করেছেন। তাঁর এই কাজে ব্যবহার করেছেন বাংলাদেশে থাকা নাইজেরিয়ান দুই ফুটবল খেলোয়াড়কে।
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুল্ক গোয়েন্দা, নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে ৫৩ বছর বয়সী স্ট্যাশিয়া শ্যান্টিয়া রোলকে ৩ কেজি ৯০০ গ্রাম কোকেনসহ আটক করে। পেশায় একজন বিক্রয়কর্মী এই নারী নিরাপত্তাকর্মীদের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য একটি কম্পিউটার ইউপিএসের ভেতর কোকেনের চালান নিয়ে যাচ্ছিলেন। পরে জানা যায়, মাদক পাচারের এই একই চক্রই ২০২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ৮ কেজি ৩ গ্রাম কোকেন পাচার করেছিল। সেই সময় মাদকসহ মালয়েশীয় নাগরিক নোমথেনডাজো তাওয়েরা সোকোকে আটক করা হয়।
বাংলাদেশে এত পরিমাণ কোকেন ব্যবহারকারী নেই। কোকেন চালানটির গন্তব্য ছিল ভারত হয়ে ইউরোপে। বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার স্ট্যাশিয়া শ্যান্টিয়া রোল ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে চালানটি গ্রহণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের হোটেল আগ্রাবাদে পৌঁছে দিলে তাঁকে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার দেওয়ার কথা ছিল।হুমায়ুন কবির খন্দকার, উপপরিচালক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কোকেন জব্দের ঘটনায় নগরের পতেঙ্গা থানায় মামলা করা হয়। পরে গ্রেপ্তার স্ট্যাশিয়া শ্যান্টিয়া রোল এ ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওই নারীর সঙ্গে মুঠোফোন, ই-মেইলে যোগাযোগ, নগরের আগ্রাবাদে তাঁর জন্য হোটেল বুকসহ কোকেন চালানটি তদারকিতে জড়িত থাকায় ঢাকা থেকে দুই নাইজেরিয়ান নাগরিক আফিজ ওয়াহাব ও ইকেচুকু এনওয়াগউকে একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। আফিজ ওয়াহাব এক বাংলাদেশি নারীকে বিয়ে করেছেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি ফেনী ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলেন। তাঁর ভিসা ২০১২-২০১৩ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। এর আগেও তিনি একই কারণে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ইকেচুকু ফুটবল খেলতেন বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে।
মামলাটির তদন্ত তদারক করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে এত পরিমাণ কোকেন ব্যবহারকারী নেই। কোকেন চালানটির গন্তব্য ছিল ভারত হয়ে ইউরোপে। বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার স্ট্যাশিয়া শ্যান্টিয়া রোল ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে চালানটি গ্রহণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের হোটেল আগ্রাবাদে পৌঁছে দিলে তাঁকে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার দেওয়ার কথা ছিল। তদন্তে দেখা গেছে, স্ট্যাশিয়া হোয়াটসঅ্যাপে জ্যাকব ফ্রাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ফুটবল খেলোয়াড় দুই নাইজেরিয়ান ঢাকায় অবস্থান করে এই চালান বহনে স্ট্যাশিয়াকে তত্ত্বাবধান করছিলেন।
হুমায়ুন কবির খন্দকার বলেন, স্ট্যাশিয়া জানিয়েছেন, তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ এবং তাঁর চিকিৎসার জন্য টাকার প্রয়োজন ছিল। তাঁর চাচাতো ভাই ডিওন পিন্ডোর তাঁকে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলে জ্যাকব ফ্রাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। জ্যাকব ফ্রাঙ্ক স্ট্যাশিয়াকে ব্রাজিলের সাও পাওলোতে এসে কিছু কাগজে সই করার জন্য বলেন। সেখানে বিমানযোগে পৌঁছানোর পর জ্যাকব ফ্রাঙ্ক তাঁকে জানান, একটি উপহারের ব্যাগ এক ব্যক্তির কাছে নিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছে দিতে হবে এবং এতে স্ট্যাশিয়া রাজি হন। এক ব্যক্তি তাঁকে লাগেজটি হস্তান্তর করেন। এমিরেটাস এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে স্ট্যাশিয়া গত বছরের ১৩ জুলাই বাংলাদেশে আসেন এবং চার দিনের অন-অ্যারাইভাল ভিসা নেন।
জ্যাকব ফ্রাঙ্কের নির্দেশনা অনুযায়ী চট্টগ্রামের হোটেল আগ্রাবাদে মুসাফির ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মাধ্যমে স্ট্যাশিয়ার থাকার ব্যবস্থা হয়। হুমায়ুন কবির খন্দকার বলেন, বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর তিনি লাগেজটি হারিয়ে ফেলেন এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে অভিযোগ জানান। পরে ১৫ জুলাই লাগেজটি খুঁজে পাওয়া গেলে স্ট্যাশিয়া যখন তা নিতে যান, তখন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সন্দেহবশত তাঁর লাগেজটি স্ক্যান করে কোকেনের আলামত দেখতে পান।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির খন্দকার আরও বলেন, গ্রেপ্তার আফিজ নাগিন নামে একজন নাইজেরিয়ার নাগরিকেরও নাম প্রকাশ করেছেন। নাগিনও দীর্ঘদিন বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন এবং কয়েক বছর আগে তিনি নাইজেরিয়ায় ফিরে যান। নাগিনই স্ট্যাশিয়ার জন্য মুসাফির ট্রাভেলসের মাধ্যমে ঢাকা-দুবাই-সাও পাওলোর ফিরতি টিকিট বুক করেছিলেন। নাগিন ট্রাভেল এজেন্সির মালিকের কাছে নিজেকে ঢাকার একটি ক্লাবের ফুটবল প্রশিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। নাগিনের পুরো নাম-ঠিকানা পেলে তাঁর বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) গ্লোবাল কোকেন রিপোর্ট-২০২৩-এর তথ্য বলছে, বিশ্বে বছরে প্রায় ২ হাজার টন কোকেন উৎপাদিত হয়। উৎপাদনকারী তিনটি দেশই দক্ষিণ আমেরিকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬১ শতাংশ কলম্বিয়ায়, ২৬ শতাংশ পেরুতে ও ১৩ শতাংশ বলিভিয়ায় উৎপাদিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, কোকেনসেবী রয়েছে বিশ্বজুড়ে। ব্যবহারকারীদের ৩০ শতাংশ উত্তর আমেরিকার, ২৪ শতাংশ দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের এবং ২১ শতাংশ ইউরোপের। এ ছাড়া আফ্রিকা ও এশিয়ায়ও সেবনকারী রয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সবচেয়ে বেশি কোকেন পাচার হয়। এ ছাড়া সমুদ্র ও আকাশপথে ব্রাজিল হয়ে বিভিন্ন দেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে উত্তর আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে কোকেন পাচার করা হয়।
ব্রাজিল থেকে সরাসরি ইউরোপে না পাঠিয়ে বাংলাদেশকে কেন ব্যবহার করছে পাচারকারীরা, জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাতে সহজে ধরা না পড়েন, বাহককে সন্দেহমুক্ত রাখতে পাচারকারীরা বাংলাদেশকে কোকেন পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশ হয়ে ভারত, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে কোকেন পাচার হচ্ছে।’