কক্সবাজার সাগর উপকূলে কিছু ট্রলারে ধরা পড়ছে বড় সাইজের ইলিশ। এসব ইলিশ পাঠানো হয় ঢাকায়। গত শনিবার দুপুরে ফিশারিঘাটেছবি: প্রথম আলো

‘এত ইলিশ হঠাৎ কোথায় গেল’

কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর ৬ নম্বর জেটিঘাট এলাকা। নদীর আধা কিলোমিটারজুড়ে সারিবদ্ধভাবে নোঙর করা অন্তত ৭০০ মাছ ধরার ট্রলার। গত শনিবার দুপুরে একটি ট্রলারে পাশাপাশি বসে গল্প করছিলেন চার জেলে—নুর হাসান, আবু তৈয়ুব মাঝি, মো. শফি ও আবদুল কাইয়ুম মাঝি। চারজনেরই ইলিশ ধরার অভিজ্ঞতা ৮ থেকে ১২ বছর।

কথা বলতে চাইলে জেলেরা বলেন, সাগরে ইলিশের আকাল। অলস সময় কাটাচ্ছেন তাঁরা। অথচ তিন বছর আগেও বঙ্গোপসাগরে জাল ফেললে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ত। সেই ইলিশ বিক্রির টাকায় চলত সংসার ও সন্তানদের লেখাপড়া খরচ। এখন ইলিশ নেই, সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জেলেদের প্রশ্ন, এত ইলিশ হঠাৎ কোথায় গেল।

জেটিঘাটের উত্তর পাশে নুনিয়াছটা ফিশারি ঘাট ও পাইকারি মাছ বিক্রির মৎস্য অবতরণকেন্দ্র। বেলা ১১টায় সেই ঘাটে ভিড়েছে গভীর সমুদ্র থেকে আসা ছয় থেকে সাতটি ট্রলার। দুটি ট্রলারে ৭০ থেকে ১৩০টি ইলিশ ধরা পড়েছে। ইলিশগুলোর ওজন ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম। ব্যবসায়ীরা সেই ইলিশ প্রতি কেজি ২ হাজার ৩০০ টাকায় কিনে নিলেন। শহরের বাহারছড়া ও কানাইয়ার বাজারে এই ইলিশ ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

গবেষকেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরে বৃষ্টির ধরন পাল্টে গেছে এবং ঘন ঘন নিম্নচাপের সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে সাগরে আগের মতো ইলিশও আসছে না। গত কয়েক বছরে ক্রমেই ইলিশ কমছে বলে কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর জেলেদের কথা থেকে জানা গেল। এখানকারই এক জেলে মো. শফি (৪০) বলেন, আড়াই বছর আগে তাঁর ট্রলারে এক ট্রিপে (সাত দিনের যাত্রা) ২৫ লাখ টাকার ইলিশ ধরা পড়েছিল। এরপর আর কখনো একসঙ্গে তিন লাখ টাকার বেশি ইলিশ ধরা পড়েনি।

একটি ট্রলারের মাঝি সজীবুল ইসলাম (৫২) বলেন, ‘১৪ বছর ধরে সাগরে ইলিশ ধরছি, এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। সাগরে এত ঘন ঘন নিম্নচাপ ও লঘুচাপ আগে সৃষ্টি হয়নি। চলতি সেপ্টেম্বরে দুই বার লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। আগস্টে অন্তত ছয়বার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই।’

দুপুরে মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, মাছশূন্য পন্টুন পড়ে আছে। ব্যবসায়ীরা বলেন, সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত কিছু মাছ বিক্রির জন্য আনা হয়েছিল। সেখানে ইলিশ ছিল দুই মণের মতো।

জেটিঘাট এলাকায় অলস সময় কাটাচ্ছিলেন জেলে নুর হাসান। তাঁর বাড়ি কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল গ্রামে। ঘরে স্ত্রী, মা ও তিন সন্তান। হাতে টাকা নেই বলে ঘরে যেতে পারছেন না। ধারদেনায় চলছে সংসার। নুর হাসান (৩৭) বলেন, এখন ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের কোথাও ইলিশের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। গত তিন মাসে ট্রলার নিয়ে তাঁরা ২১ জেলে অন্তত ১০ বার সাগরে নেমেছেন। প্রতিবার ফিরে এসেছেন ১০০ থেকে ২০০টি ইলিশ নিয়ে। একবার ট্রলার নিয়ে সাগরে নামলে পাঁচ থেকে সাত দিন থাকতে হয়। এতে জ্বালানি ও খাদ্যসামগ্রীর বিপরীতে খরচ হয় প্রায় চার লাখ টাকা। মাছ বিক্রি করে পাওয়া যায় এক লাখ টাকার মতো। ইলিশ ধরা না পড়ায় জেলেপল্লিতে হাহাকার চলছে। ৭০ শতাংশ জেলে পরিবারে এক বেলা খাবার জুটছে না।

গবেষকেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরে বৃষ্টির ধরন পাল্টে গেছে এবং ঘন ঘন নিম্নচাপের সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে সাগরে আগের মতো ইলিশও আসছে না। গত কয়েক বছরে ক্রমেই ইলিশ কমছে বলে কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর জেলেদের কথা থেকে জানা গেল। এখানকারই এক জেলে মো. শফি (৪০) বলেন, আড়াই বছর আগে তাঁর ট্রলারে এক ট্রিপে (সাত দিনের যাত্রা) ২৫ লাখ টাকার ইলিশ ধরা পড়েছিল। এরপর আর কখনো একসঙ্গে তিন লাখ টাকার বেশি ইলিশ ধরা পড়েনি। ইলিশ ধরা পড়লে ট্রলারের মালিক ও জেলে সবারই লাভ। আর ধরা না পড়লে লোকসান হয় বলে সাগরে ট্রলার নামানো হয় না। এতে প্রতিবছরই জেলেদের আয় কমছে।

কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, জেলার টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সদর, পেকুয়া, চকরিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলায় ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ আহরণের ট্রলার রয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি। জেলের সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজারের মতো। কিন্তু টানা ছয় থেকে সাত মাস তেমন মাছ ধরা পড়ছে না। বঙ্গোপসাগর দিন দিন ইলিশশূন্য হয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধানে গবেষণার দরকার।

কয়েকজন ট্রলারের মালিক ও জেলে জানান, গভীর সাগরে দেশি–বিদেশি ট্রলিং জাহাজের আনাগোনা বেড়েছে। ট্রলিং জাল, নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ও বেহেন্দি জালে নির্বিচার মাছ আহরণ ও ঘন ঘন নিম্নচাপের কারণে এমন পরিস্থিতি হতে পারে।

কক্সবাজার মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের দেওয়া তথ্যমতে, ইলিশের আহরণ দিন দিন কমছে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে এই মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৯৭৫ মেট্রিক টন ও ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ২ হাজার ৫৫৬ মেট্রিক টন। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ১ হাজার ৬২৮ মেট্রিক টন ইলিশ বিক্রি হয়েছে। আর চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের আগস্ট পর্যন্ত দুই মাসে ইলিশ বিক্রি হয়েছে ২৬৭ মেট্রিক টন।

মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের বাণিজ্যিক (মার্কেটিং) কর্মকর্তা মো. গোলাম রব্বানী বলেন, ইলিশ আহরণ কমে যাওয়ায় সরকারের রাজস্বও কমছে। ফিশারি ঘাট ছাড়া জেলার টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, চকরিয়া, কুতুবদিয়া ও মহেশখালীতে ইলিশ বিক্রির কয়েকটি কেন্দ্র আছে। সেখানেও তেমন ইলিশ বিক্রি হচ্ছে না। জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, গত বছর জেলায় ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৩৯ হাজার ৩১৪ মেট্রিক টন। এবার ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার মেট্রিক টন।