বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে প্রতিদিন শত শত টন ইউরিয়া সার পাচার হয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কপথ ও কর্ণফুলীর নদীর মোহনা ও বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা দিয়ে সাগরপথে চোরাকারবারিরা কৃষির অন্যতম উপকরণ মূল্যবান এই সার পাচার করে দিচ্ছে। দেশে উৎপাদিত এবং সরকারিভাবে বিদেশ থেকে আমদানি করা ভর্তুকি মূল্যের এই সার পাচার হওয়ায় কৃষক ও কৃষি অর্থনীতি বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের আর্থিক গচ্চাও কম নয়। বিপরীতে চোরাকারবারিরা লুফে নিচ্ছে বাড়তি মুনাফা। তবে এর চেয়েও ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে-সারের বিপরীতে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ঢুকছে ইয়াবা, আইসসহ বিভিন্ন ধরনের মরণঘাতী মাদকের চালান। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের একাধিক চোরাকারবারি সিন্ডিকেট প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করেই পাচার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
কোস্ট গার্ড মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়াম-উল-হক জানান, সাগরপথে ইউরিয়া সারসহ বিভিন্ন পণ্য বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে। আবার সেখান থেকে ঢুকছে মাদকদ্রব্য। দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টিকারী চোরাচালান ও মাদক পাচার রোধে কোস্ট গার্ড সবসময় সচেষ্ট রয়েছে। ভবিষ্যতেও এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে যে সার প্রতি বস্তা ১ হাজার ২৫০ টাকা বিক্রি হয় তা মিয়ানমারে বিক্রি হয় ৬ হাজার টাকা। ফলে মিয়ানমারে পাচার করলে প্রতি বস্তায় ৪ হাজার ৭৫০ টাকা লাভ হয়। এর মধ্যে প্রশাসন ম্যানেজসহ বিভিন্ন খাতে বস্তাপ্রতি ১ হাজার টাকা ব্যয় হলেও ৩ হাজার ৭৫০ টাকা মুনাফা থাকে। বিপুল পরিমাণ এই মুনাফার লোভেই চোরাকারবারিরা ভর্তুকি মূল্যের কৃষকের এই সার মিয়ানমার পাচার করে দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের মুদ্রার চেয়ে মিয়ানমারের মুদ্রার মান অনেক কম হওয়ায় পাচারকারীরা পণ্যের বদলে পণ্য বিনিময় করছে। এতে এ দেশীয় পণ্য পাচারের বিপরীতে মিয়ানমার থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আসছে মাদক দ্রব্য। এতে দুদিকেই লাভবান হচ্ছে পাচারকারীরা।
যেভাবে পাচার হচ্ছে : অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক দিয়ে ট্রাকে এবং কর্ণফুলী নদীর মোহনা, আনোয়ারাসহ বিভিন্ন উপকূল দিয়ে নৌযান ও মাছধরা ট্রালের সাগরপথে সার পাচার হচ্ছে। সড়কপথে খরচ ও ঝুঁকি খানিকটা বেশি থাকায় চোরাকারবারিরা নদীপথকেই রুট হিসাবে বেছে নেয়। চাক্তাই চামড়ার গুদাম ও ভেড়া মার্কেটের একাধিক চক্র সেখান থেকে কর্ণফুলী হয়ে নদীপথে সার পাচার করছে।
একদিকে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, মাঝে নাফ নদী; অপরপ্রান্তে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। ওই সীমান্ত দিয়েই সার পাচার হচ্ছে। একইভাবে মিয়ানমার থেকে চোরাকারবারিরা নিয়ে আসছে ইয়াবা ও আইসসহ বিভিন্ন ভয়ংকর মাদক।
অনেকক্ষেত্রে সারসহ বিভিন্ন পণ্যের বিনিময় মূল্য ধরেই সর্বনাশা মাদকদ্রব্য নিয়ে আসছে চোরাকারবারিরা। এতে টাকা লেনদেন বা হুন্ডির ঝুঁকিও কম। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপকূল চোরাকারবারিদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। চোরচালানের জন্য তারা রাতের আঁধারকেই বেছে নেয়। চট্টগ্রামের আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও পতেঙ্গার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মাদকদ্রব্য খালাস করা হচ্ছে। এই চোরাকারবারির সঙ্গে উপকূলীয় এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে দুই দেশের মাফিয়াচক্র জড়িত। তারা সীমান্তে বিজিবি এবং রাখাইনে আরাকান আর্মি ছাড়াও পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর সদস্যদের ম্যানেজ করেই চোরাচোলান অব্যাহত রেখেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (চট্টগ্রাম) অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ‘সরকার ইউরিয়া সারে মোটা অঙ্কের ভর্তুকি দেয়। কিন্তু এই সার মিয়ানমারে পাচার হয়ে যাচ্ছে এমন খবর উদ্বেগজনক। যদিও ডিলারদের কঠোরভাবে নির্দেশনা দেওয়া আছে, এই সার কার কাছে কী পরিমাণ বিক্রি করছে তার সঠিক তথ্য রাখতে। তিনি জানান, কোনো ডিলার যদি এই হিসাব দিতে না পারে বা কারও বিরুদ্ধে পাচারের সুনির্দ্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে নদী ও সড়কপথে মিয়ানমারে প্রতিদিন টন টন সার পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে পাচার অব্যাহত থাকলে সামনের ইরি-বোরো মৌসুমে দেশে সারের ভয়াবহ সংকট দেখা দেবে। সারসহ বিভিন্ন পণ্য পাচাররোধ এবং মাদকদ্রব্য প্রবেশ বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ‘কে শোনে কার কথা।’ ২০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকেও সার পাচার ও মাদক চোরাচালান বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ সালাউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড রোধে উপজেলা প্রশাসন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। এই অভিযান আরও জোরদার করা হবে। যে কোনো ধরনের চোরাচালান বা পাচার কার্যক্রম রোধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে।
তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে গুরত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সারসহ সব ধরনের পণ্য অবৈধভাবে মিয়ানমারে পাচার যেকোনো মূল্যে ঠেকানো হবে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ স্থানীয়দের পাশাপাশি রোহিঙ্গারাও এসব পাচার ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত।
অভিযান : গত ৬ মাসে কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশ বেশ কিছু চোরাচালান পণ্য জব্দ করে। এই সময়ে শতাধিক ক্যারিয়ার বা বহনকারীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৪ মে কুমিরা নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে মিয়ানমারে পাচারকালে ৩৪০ বস্তা বা ১৭ হাজার কেজি ইউরিয়া সার জব্দ করে। কাফকো থেকে বের হওয়া এই সার মাছধরা ট্রলারে করে জালের নিচে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে মিয়ানমারে পাচারের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ওই ট্রলারটিও জব্দ করা হয়। চলতি বছরের ২৬ জুন কোস্ট গার্ড সাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে অভিযান চালিয়ে ৪৩০ বস্তা ইউরিয়া সার, ৬০০ বস্তা আলু, ৪০ লিটার লুব অয়েল উদ্ধার করা করে। এর সঙ্গে জড়িত ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এভাবে একাধিক অভিযানে বিপুল পরিমাণ ইউরিয়া সার ও মাদক জব্দ করা হয়।