ছবি: সংগৃহীত

হামলায় অংশ নেয় আ.লীগ, আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা

ফরিদপুর-৪ আসন পুনর্বিনাসের ঘটনায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে ভাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন স্থাপনায় হামলায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় বেশ কিছু নেতাকর্মী। বিএনপির একটি অংশও এতে অংশ নেয়। ভিডিও ফুটেজে এদের অনেকের চেহারা দেখা গেছে। দুটি ইউনিয়ন অন্য আসনে নিয়ে যাওয়ায় সেখানকার সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে পুঁজি করেন তারা। এতে ইন্ধন দেন আওয়ামী লীগের পলাতক কিছু নেতা। এরা সীমানা পুনর্নির্ধারণের আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ দেওয়ার চেষ্টা চালায়। তারা ফেসবুক পোস্টে এ আন্দোলন উসকে দেন। এ ঘটনায় আলগী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান স্থানীয় আওয়ামী নেতা মো. মনিরুজ্জামান সিদ্দিক মিয়াকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হামিরদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা খোকন মাতুব্বর পলাতক। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ। এছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী এলাকায় ছিলেন, তাদের বেশির ভাগই গা ঢাকা দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে সরকারি স্থাপনায় হামলার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সীমানা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ জানিয়ে সোমবার চিঠি দেন ফরিদপুর জেলা প্রশাসক। একই সঙ্গে তার অনুরোধে রোববার পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেছেন ভাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার ইকবাল হোসেন সেলিম। তার ঘোষণা শেষে মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ফলে ঢাকার সঙ্গে বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের ২১ জেলার যাতায়াত ব্যবস্থা সচল হয়। তবে নিরাপত্তা বিবেচনায় ভাঙ্গার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন আছে।

জানতে চাইলে ভাঙা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফ হোসেন বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১২০০ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। তিনি বলেন, ভিডিও ফুটেজে অনেকের চেহারা দেখা গেছে। ফুটেজ দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে তদন্তের স্বার্থে কারও নাম বলেননি তিনি।

মঙ্গলবার সরেজিমন দেখা গেছে, উপজেলা প্রশাসন এলাকায় ভাঙা চেয়ার, কাচের টুকরো, ক্ষতিগ্রস্ত গাড়িসহ হামলার ক্ষত রয়ে গেছে। ভাঙ্গা থানায় পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর অবস্থায় রয়েছে। সামনের গ্লাস ভেঙে দেওয়ায় সেখানে পলিথিন বেঁধে দেওয়া হয়েছে। থানার সামনেই গত ৬ বছর ধরে আখের রস বিক্রি করেন মো. সুমন। হামলার সময়ে সেখানে তিনি উপস্থিত ছিলেন। সুমন জানান, হামলার সময়ে শত শত মানুষ একযোগে থানায় ঢুকেছে। সেখানে আওয়ামী লীগের পরিচিত অনেকেই ছিলেন। বিএনপির লোকজনকেও দেখা গেছে। তিনি বলেন, এখানকার মানুষ ওই দুটি ইউনিয়ন ফরিদপুর-৪ আসনের অন্তর্ভুক্ত থাকুক, সেটাই চায়। আলগী ইউনিয়নের সীমানা থানা থেকে কয়েকশ গজ দূরে। অথচ সেটিকে ফরিদপুর-২ আসনে যুক্ত করা হয়েছে। যেখানে ভ্যানে চড়ে গেলেও ১০০-১২০ টাকা ভাড়া গুনতে হবে। প্রায় একই ধরনের তথ্য জানান সেখানকার আরও কয়েকজন।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অনেকটা আকস্মিকভাবে সীমানা পুনর্নির্ধারণের খবর পান তারা। এরপর থেকেই আন্দোলন শুরু। তারা বলেন, ওই আন্দোলন এতটা মারমুখী হবে তা আগে থেকে বুঝে উঠতে পারেননি। সীমানা পুনর্নির্ধারণের আন্দোলন সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরের চেষ্টা করা হয়েছে। দুটি ইউনিয়নকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে-স্থানীয় মানুষের এই মনোভাব কাজে লাগিয়ে ওই হামলার ঘটনা ঘটানো হয়। হামলায় সাধারণ মানুষ ও বিএনপির কিছু নেতাকর্মীও ছিলেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, হামলায় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীও অংশ নেন। শহীদুর রহমান বুলবুল, পলাশ মিয়াসহ কয়েক জনের ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। এর আগে ওই এলাকার পলাতক সংসদ-সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন ভিডিও বার্তাও দেন। আওয়ামী লীগের পলাতক কয়েকজন নেতা সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে ফেসবুকে পোস্ট দেন।

ভাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার ইকবাল হোসেন সেলিম বলেন, জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে তারা হামলা চালিয়েছে। জয় বাংলা স্লোগান দেয় আওয়ামী লীগ। হামলায় তাদের নেতাকর্মীদের উপস্থিতির ভিডিও রয়েছে।

আন্দোলন স্থগিত : মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে দুটি ইউনিয়ন পুনর্বহালের দাবিতে উপজেলা বিএনপির পক্ষ হতে ভাঙ্গা ঈদগা মাদ্রাসা ময়দান থেকে একটি সংক্ষিপ্ত মিছিল বের হয়। মিছিল থেকে সাবেক এমপি নিক্সন চৌধুরীকে উদ্দেশ করে স্লোগান দেওয়া হয়। মিছিল শেষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে আন্দোলন ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিতের ঘোষণা দেন ভাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার ইকবাল হোসেন সেলিম। আরও বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব মোল্যা ও উপজেলা এনসিপির প্রধান সমন্বয়ক মো. আশরাফ।

এনসিপির প্রধান সমন্বয়ক মো. আশরাফ বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের পর তাদের দোসররা এখনো সোচ্চার। এ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য নিক্সন চৌধুরী এক ভিডিও বার্তায় উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার পর তার অনুসারীরা ভাঙ্গায় থানা, উপজেলা পরিষদে হামলা চালিয়ে ব্যাপক নাশকতা করেছে। আমরা এই বিশৃঙ্খলাকারী ওতপেতে থাকা স্বৈরাচারের দোসরদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।

ভাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব মোল্যা বলেন, আমাদের উপজেলার আলগী ও হামিরদী ইউনিয়ন যাতে ফরিদপুর ২ আসনে না নেওয়া হয় সেই বিষয়ে নেতারা মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট করেছেন। চলতি মাসের ২১ তারিখ রিটের শুনানি হওয়ার কথা। আমরা জেলা প্রশাসনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এবং মহামান্য হাইকোর্টের শুনানির অপেক্ষা করে অবরোধ শিথিল করেছি। কিন্তু আমাদের শিথিলতা ও রাস্তায় না থাকার সুযোগে একটি কুচক্রী মহলের ইন্ধনে তার সাঙ্গপাঙ্গরা ভাঙ্গায় ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি বানচাল করতে চাচ্ছে। আমরা কুচক্রী মহলের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।

ইসিকে ডিসির চিঠি : সোমবার দিনভর হামলার পর ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান মোল্লা ভাঙ্গার আলগী ও হামিরদী ইউনিয়নকে ২১৪ ফরিদপুর-৪ আসনে অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়ে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব বরাবর চিঠি দেন। এতে বলা হয়, ফরিদপুর-৪ এর অন্তর্গত ভাঙ্গার আলগী ও হামিরদী ইউনিয়ন দুটি জাতীয় সংসদীয় আসন ফরিদপুর-২ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তালিকা প্রকাশের পর ৪ সেপ্টেম্বর থেকে আলগী ও হামিরদী ইউনিয়নসহ ভাঙ্গা উপজেলার সাধারণ মানুষ আসন বিন্যাস বাতিলের দাবিতে মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধসহ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন শুরু করেন। এতে ক্রমান্বয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। সর্বশেষ ১৫ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভকারীরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কার্যালয়, উপজেলা নির্বাচন অফিসারের কার্যালয়, ভাঙ্গা থানা, হাইওয়ে পুলিশের কার্যালয় ও সরকারি গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়াও বিক্ষোভকারীরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে রাখে। এতে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যাহত হয়। ফলে সাধারণ জনগণকে তীব্র ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়।

সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাসের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা না হলে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতির শঙ্কা রয়েছে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন ডিসি-এসপির : এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ফরিদপুরের ডিসি ও এসপি। জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান মোল্যা বলেন, ভাঙ্গার আলগী ও হামেরদি ইউনিয়ন পুনর্বিন্যাসের বিষয়ে ইলেকশন কমিশন সচিব মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলেছি এবং সোমবার একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ভাঙ্গাবাসীকে ধৈর্য ধারণের জন্য বলা হয়েছে।

জেলা পুলিশ সুপার মো. আব্দুল জলিল বলেন, কিছু দুষ্কৃতকারী ভাঙ্গায় থানা, হাইওয়ে থানা ও উপজেলা পরিষদে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দিয়ে নাশকতা করেছে। তাদের বিষয়ে পুলিশের পক্ষ হতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ টহল রয়েছে।

রুল ও ডিসির চিঠি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেবে ইসি-সচিব : ফরিদপুরে সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তন নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আদালতের রুল ও জেলা প্রশাসকের (ডিসি) চিঠি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইসি সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের কাছে এমন মন্তব্য করেন।

সচিব বলেন, যেহেতু রিটের ব্যাপারটা আছে। অতএব কমিশন এটা রিট এবং ডিসি সাহেবের যে সুপারিশ, এগুলো বিবেচনায় নিয়ে যেটা আইনগতভাবে প্রযোজ্য সেটাই ব্যবস্থা নেবেন। এটা হচ্ছে সচিব হিসাবে আমার কথা। তবে কমিশন এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। কমিশন এটা পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে।

এর আগে সোমবার ফরিদপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসক ইসি সচিবকে চিঠি দিয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানান। অপরদিকে ইসির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা এক রিট আবেদনের ওপর মঙ্গলবার শুনানি করেন হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। শুনানি শেষে রুল জারি করেন আদালত। রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে, এই প্রজ্ঞাপন (সীমানা পুনর্নির্ধারণের) কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না। রুলের জবাব দিতে সংশ্লিষ্টদের আগামী ১০ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব।