প্রতীকী ছবি

গাজীপুরে হাইওয়েজুড়ে ছিনতাই-ডাকাতি

সন্ধ্যা নামতেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে প্রাইভেটকার নিয়ে নেমে পড়ে সংঘবদ্ধ ডাকাত ও ছিনতাইকারীচক্র। রাত যত গভীর হয়, তত তাদের দাপট বাড়তে থাকে। যাদের প্রধান টার্গেট পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারীও নিরাপদ নয়। নানা কৌশলে গতিরোধ করে রামদা, চাপাতি, রডসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অস্ত্রের মুখে পিটিয়ে ছিনিয়ে নেয় মালামাল ও নগদ অর্থ। এছাড়াও যাত্রীবাহী পরিবহণ এসব ছিনতাইকারী ও ডাকাতচক্রের হাতে একরকম জিম্মি হয়ে পড়েছে।

গত তিন মাসে ২০-২৫টি ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। অনেকে ঝামেলা এড়ানোর ভয়ে পুলিশ রিপোর্ট করতে চান না। তবে এ বিষয়ে জিডি-মামলা করা নিয়েও ভোগান্তির শেষ নেই। ঘটনার সব প্রমাণ থাকার পরও পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে। সর্বশেষ মঙ্গলবার রাতে সদর থানা এলাকায় এই ডাকাতচক্রের কবলে পড়ে দাদা গ্রুপ অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ফ্যাক্টরির মালবাহী কাভার্ড ভ্যান। এ অবস্থায় শিল্পাঞ্চলখ্যাত গাজীপুরে সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করা নিয়ে জনমনে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার মো. জাহিদুল হাসান বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘গত এক সপ্তাহের মধ্যে মহাসড়কে ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের কোনো ঘটনা ঘটেনি। বাকিটা আপনারা বলতে পারবেন। আমাদের যে জনবল আছে, তা নিয়ে আমরা রাতদিন কাজ করছি। আপনারাও একটু খেয়াল রাখবেন। আমরা আছি, বাকিটা আল্লাহ ভরসা।’

থানায় দায়ের করা এজাহার সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার রাজধানীর মতিঝিল থেকে দাদা গ্রুপ অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ফ্যাক্টরির মালামাল নিয়ে গাজীপুরের শ্রীপুরে ফ্যাক্টরিতে ফিরছিলেন প্রতিষ্ঠানটির ড্রাইভার মো. ফরহাদ (২৫)। কাভার্ড ভ্যানটি নিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে গজারিয়াপাড়ায় পৌঁছলে রাত ৩টার দিকে একটি প্রাইভেটকার গাড়ির গতিরোধ করে। এরপর অন্তত চারজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি গাড়ি থেকে নেমে তাদের দেশীয় অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করে। একপর্যায়ে কাভার্ডভ্যানে থাকা ২ লাখ টাকার বেশি মূল্যের মালামাল, ড্রাইভার-হেল্পারের মোবাইল ফোন ও টাকা নিয়ে চলে যায়। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে মামলার আবেদন করা হলে পুলিশ তা নিতে অস্বীকার করে। তদন্ত ছাড়া মামলা নেওয়া যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর সদর থানার ওসি মেহেদী হাসান যুগান্তরকে বলেন, মঙ্গলবার রাতের ঘটনায় আমরা প্রাথমিক তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছি। শিগ্গিরই জড়িতদের শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এর আগে গত মাসে একই প্রতিষ্ঠানের ম্যাকানিক মাহিন ঢাকা থেকে ফ্যাক্টরির প্রয়োজনীয় মালামাল কিনে শ্রীপুর ফিরছিলেন। পথিমধ্যে রাত ১০টার দিকে জয়দেপুর চৌরাস্তা মোড়ে ফ্লাইওভারের নিচে বাস থেকে নেমে দাঁড়িয়ে থাকাবস্থায় একটি প্রাইভেটকারে আসা অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা তাকে জোর করে তুলে নেয়। এরপর গাড়ির মধ্যে হাতপা বেঁধে ফেলে তার কাছ থেকে নগদ টাকা এবং প্রতিষ্ঠানটির মালামাল ছিনিয়ে নেয়।

এদিকে ২৩ আগস্ট গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে কুপিয়ে এবং ককটেল ফাটিয়ে এক বিকাশ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নগদ আড়াই লাখ টাকা এবং মালামাল লুট করে দুর্বৃত্তরা। কোনাবাড়ী বাইমাইল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় প্রাইভেটকারে আসা দুষ্কৃতকারী দল দেশীয় অস্ত্র দিয়ে বিকাশ ব্যবসায়ী আমিনুর ইসলামকে আঘাত করলে তার গালে চারটি সেলাই দিতে হয়।

আমিনুর ইসলাম (৩৫) কোনাবাড়ী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা এবং আমিনুর টেলিকমের কর্ণধার। তিনি দীর্ঘদিন ওই এলাকায় বিকাশের এজেন্ট হিসাবে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। তিনি জানান, রাত ১০টার দিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার পথে কোনাবাড়ীর এক স্থানে ওত পেতে থাকা দুষ্কৃতকারী চক্রের কবলে পড়েন। প্রাইভেটকারে আসা ২ জন দেশীয় অস্ত্র দিয়ে তাকে আঘাত করে এবং তার কাছে থাকা বিকাশের আড়াই লাখ টাকা, ৬০ হাজার টাকার মিনিট কার্ড, একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন এবং ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত ৫টি বাটন মোবাইল ফোন লুট করে নিয়ে যায়।

এদিকে শ্রীপুরে মঙ্গলবার রাত পৌনে ১০টায় মাওনা-ফুলবাড়িয়া সড়কে গাছ ফেলে ডাকাতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ডাকাতরা পল্লী বিদ্যুতের দুই কর্মীকে জঙ্গলে বেঁধে রেখে তাদের মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোন ও টাকা লুট করে নিয়ে গেছে। ডাকাতির শিকার ব্যক্তিরা হলেন-শিমলাপাড়া পল্লী বিদ্যুৎ অভিযোগকেন্দ্রের ইনচার্জ নিরঞ্জন মণ্ডল (৫০) ও লাইনম্যান তৌহিদুল ইসলাম (৩৮)। শ্রীপুর থানার ওসি আব্দুল বারিক বলেন, ওই সড়কে পুলিশের একটি দল ডিউটিতে ছিল। একটি মোটরসাইকেল এবং মোবাইল ফোন টান দিয়ে নিয়ে গেছে বলে জানতে পেরেছি। তবে কোনো ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি।

এর আগে গত ১৬ মে টঙ্গীতে উড়াল সড়কের ওপর ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে রনজু খাঁ নামের এক প্রাইভেটকার চালকের মৃত্যু হয়। ১০ জুলাই রাতে টঙ্গীর সড়ক ও জনপথ কার্যালয়ের সামনে ছিনতাইকারীর হামলায় খুন হন কলেজ শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান। ১৯ জুন শ্রীপুরের সাতখামাইড় সড়কে গভীর রাতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি হয়েছে। এই ঘটনার সময় সিএনজি অটোরিকশাচালক মো. আবুল কালামকে (৩০) কুপিয়ে হত্যা করেছে ডাকাতরা। সাংবাদিক প্রতাপ কুমার গোপ (৫৩) গত বৃহস্পতিবার গাজীপুর সদর এলাকার ছোট দেওড়া থেকে জয়দেবপুর যাওয়ার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। তার কাছ থেকে নগদ টাকা, মোবাইলসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও কার্ড ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনায় তিনি সদর থানায় মামলার আবেদন করলে সেটি হারানোর জিডি হিসাবে রেকর্ড করা হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, চলিত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত গত ছয় মাসে গাজীপুর মহানগরে দস্যুতা ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৩৪টি মামলা হয়। এর আগের ছয় মাসে মামলা হয় ২৬টি। যদিও অনেক ঘটনার ক্ষেত্রেই পুলিশ মামলা নিতে চায় না। আবার হয়রানি ও ভোগান্তির আশঙ্কায় ভুক্তভোগীরাও মামলায় আগ্রহী হন না। অনেক সময় ছিনতাই-ডাকাতির মতো ঘটনা উল্লেখ না করে মূল্যবান জিনিসপত্র হারানোর সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়।

ভুক্তভোগীদের অনেকে জানান, রাতে সড়ক ও মহাসড়কে পুলিশের পর্যাপ্ত টহল না থাকায় ছিনতাইকারী ও ডাকাতচক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে না পারলে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা আরও বাড়তে থাকবে।