রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে ‘নুরাল পাগলা’র দরবারে হামলা, তার মরদেহ কবর থেকে তুলে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় দুপক্ষকেই দায়ী করলেন রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার। গতকাল রোববার কালবেলার কাছে তিনি ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেন। এদিকে ঘটনার দিন পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর উত্তেজিত জনতা নুরাল পাগলার দরবার শরিফে হামলা চালান। তারা কবর থেকে নুরাল পাগলার মরদেহ তুলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। হামলা-সংঘর্ষে আহত হন দুপক্ষের শতাধিক মানুষ। এ ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন মো. রাসেল মোল্লা (২৮) নামে নুরাল পাগলার এক ভক্ত।
ঘটনার বর্ণনা দিয় জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার কালবেলাকে বলেন, ‘২৩ আগস্ট নুরাল পাগলা মারা যান। দরবারে তার কবর দেওয়া হয়। ২৪ আগস্ট স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী, খেলাফতে মজলিস, ইসলামী আন্দোলন, ইমাম কমিটিসহ কিছু সমমনা দল ব্যাপারটা প্রতিবাদ করে। তারা একটি বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেয় ২৬ আগস্ট। এটা আমরা ২৪ আগস্টের রাতেই শুনলাম। শোনার পরে ২৫ আগস্ট সোমবার আমরা ওখানকার ইউএনও-ওসিসহ প্রতিবাদকারী দল এবং নুরাল পাগলার ভক্তদের জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে ডাকলাম। সম্মেলন কক্ষে দুপক্ষের সঙ্গে আমাদের মিটিং হলো। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো ৩০ আগস্ট শনিবারের মধ্যে তিনটি জিনিস পালটাতে হবে। এগুলো হলো কবরের রং, যেটা কাবার আদলে করা, সেটি বদলাতে হবে; কবরে ইমাম মাহাদি লেখা শব্দ মুছে ফেলতে হবে এবং ১২ ফুট উচ্চতার যে কবর, সেটা সমতল করতে হবে; কিন্তু পরে নুরাল পাগলার ভক্তরা শুধু দুটি কাজ করলেন, রং চেঞ্জ করলেন এবং ইমাম মাহাদি লেখা মুছে দিলেন; কিন্তু কবরটি নামানোর কোনো লক্ষণ নেই।’
জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার বলেন, ‘২৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার জেলার আইনশৃঙ্খলার সর্বোচ্চ ফোরাম—যেখানে সেনাবাহিনী থাকে, পুলিশ, র্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই, বিজিবি থাকে; জেলা প্রশাসন আমরা সেই মিটিং আহ্বান করলাম। মিটিংয়ে আমরা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আন্দোলনকারী দলগুলোর সঙ্গে কথা বললাম। তার কিছুক্ষণ পরে নুরাল পাগলার পরিবারের সঙ্গে কথা বললাম। তারা সময় নিলেন ৪ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবারের মধ্যে কবর নামিয়ে ফেলবেন। তারপর আগস্ট মাসের ২৯, ৩০, ৩১ এবং সেপ্টেম্বরের ১ তারিখও গেল। ২ সেপ্টেম্বর ‘ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি’ সংবাদ সম্মেলন করে আমাকে স্মারকলিপি দিল। এরপর অনেকবার দরবারে ইউএনও-ওসি গেলেন তাদের বোঝানোর জন্য। তারা কিন্তু কবর সমতল করার কাজটি করছিলেন না। তারা এটা-সেটা অজুহাত দেখাতে লাগলেন।’
ডিসি আরও বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকেলে এসে আমাকে আন্দোলনকারীরা বললেন, তারা শুক্রবার একটি সমাবেশ করবে। আমি সমাবেশ করার জন্য তাদের নিষেধ করলাম। বললাম, নুরাল পাগলার পরিবার বলেছে, কবর সমতল করবে, তারা একটু সময় চায়, ভক্তদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। এ সময় সমাবেশ করা উচিত হবে না। এতে উত্তেজনা তৈরি হবে। তারা বলল, কোনো সমস্যা নেই, তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবে। তারপর তো শুক্রবারের (৫ সেপ্টেম্বর) ঘটনা আপনারা অবগত। সার্বিকভাবে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে নুরাল পাগলার পরিবার চরম অনমনীয় মনোভাব পোষণ করেছে। বারবার তারা কালক্ষেপণ করার কারণেই বিষয়টি এত জটিল হয়েছে।’
সুলতানা আক্তার কালবেলাকে বলেন, ‘তাদের কর্মীদের ওপর আন্দোলকারী নেতাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ (কন্ট্রোল) নেই, এটা আমরা দেখলাম। তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অঙ্গীকার করে গেলে; কিন্তু সেটা আর শান্তিপূর্ণ থাকল না। সার্বিক পরিস্থিতির জন্য নুরাল পাগলার পরিবার বা তার ভক্তরা যেমন দায়ী, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের কথা বলে অশান্তি সৃষ্টির জন্য আন্দোলনকারীরাও দায়ী।’
জড়িতদের শাস্তি চাইলেন ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির সভাপতি: দরবারে হামলা ও কবর থেকে লাশ তুলে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাকে ন্যক্কারজনক অভিহিত করে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন গোয়ালন্দ উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা ইমাম কমিটির সভাপতি মাওলানা মো. জালাল উদ্দিন প্রামাণিক। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক কোথা এসে আমাদের সমাবেশকে অশান্ত করে দিল। আমাদের কথাই ছিল শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে দোয়া করে চলে যাব। উচ্ছৃঙ্খল লোকজন এসে এমনটি করবে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। যারা এ ধরনের ন্যক্কারজনক কাজ করেছে তাদের আমরা চিনিও না, ওরা আমাদের কেউ না। ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের দাবি জানাই। এ ছাড়া এ ঘটনার আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। খারাপ কাজের নিন্দা করা উচিত, আমরা নিন্দা জানাই।’
গ্রেপ্তার ৭: নুরাল পাগলার দরবার শরিফে হামলার সময় পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে অজ্ঞাতপরিচয় সাড়ে ৩ হাজার জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে উপপরিদর্শক (এসআই) সেলিম মোল্লা বাদী হয়ে গোয়ালন্দ ঘাট থানায় মামলাটি করেন। এ মামলায় এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গ্রেপ্তাররা হলেন উজানচর ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা এলাকার মো. লাল মিয়া মৃধার ছেলে মো. হিরু মৃধা, পৌর শহরের দেওয়ানপাড়ার আবজাল সরদারের ছেলে শাফিন সরদার, জহির উদ্দিনের ছেলে এনামুল হক জনি, কাজীপাড়ার আরিফ কাজীর ছেলে অপু কাজী, উজানচর দিরাজতুল্লা মৃধাপাড়ার মৃত আক্কাছ মৃধার ছেলে মাসুদ মৃধা, গোয়ালন্দ মৃধাডাঙ্গী এলাকার মকলেছুর রহমানের ছেলে মো. হায়াত আলী মৃধা ও মাল্লাপট্টি এলাকার শওকত সরদারের ছেলে মো. জীবন সরদার।
গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম বলেন, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ দেখে এ পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছি। আরও ফুটেজ পর্যালোচনা চলছে। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হবে। নুরাল পাগলার বাড়িতে যারা হামলা চালিয়েছে, ওখানে যারা হত্যার সঙ্গে জড়িত, তাদেরও আমরা আইনের আওতায় আনব।
নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে ওসি বলেন, তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ চলছে। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে থানায় এজাহার দেবেন এবং এজাহার দিলে আমরা মামলা নেব।
এদিকে রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ আল রাজীব বলেন, আসামি কাজী অপু আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর, লাশ উত্তোলন ও মাজার ভাঙচুরের কথা স্বীকার করেছে সে।
শরীফ আল রাজীব আরও বলেন, যারা মানুষের শান্তি বিনষ্ট করতে চায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
‘আমার ছেলের মুখটা হাতুড়ি দিয়ে বাড়াইছে, পেছনে কোপাইছে’: কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিহত রাসেলের বাবা ও দেবগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান মো. আজাদ মোল্লা কালবেলাকে বলেন, ‘রাসেল ছোটবেলা থেকেই গোয়ালন্দ পাক দরবার শরিফে যাওয়া-আসা করত। রাসেলের দাদা, অর্থাৎ আমার বাবা অনেক আগে থেকেই গোয়ালন্দ পাক দরবার শরিফের ভক্ত ছিল। সে কারণে রাসেল ছোট থেকেই ওই দরবারের ভক্ত। ঘটনার দিন রাসেল দরবার শরিফে গেছিল। আমি শুনলাম লোকজন এসে ওদের আটক করেছে। ওগেরে মাইরে হাসপাতালে পাঠায়ছে। পরে শুনলাম হাসপাতালে মারা গেছে। আমার ছেলের মুখটা হাতুড়ি দিয়ে বাড়াইছে (পিটিয়েছে), পেছনে কোপাইছে। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই।’