চরিত্রই চলচ্চিত্রের প্রাণ

চরিত্রই চলচ্চিত্রের প্রাণ

করপোরেট সেক্টর থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রের ক্যামেরার আড়াল—নির্মাতা আলী জুলফিকার জাহেদীর যাত্রাটা সিনেমার মতোই নাটকীয়। কবিতা থেকে গান, গান থেকে গল্প, আর গল্প থেকে সিনেমা—এ সৃজনশীল ভ্রমণের গল্প শোনালেন তিনি। লিখেছেন রাজু আহমেদ

আপনি কখন এবং কীভাবে সিনেমা নির্মাণের প্রতি আগ্রহী হলেন? প্রথম অনুপ্রেরণা কী ছিল?

জাহেদী: আমি মূলত করপোরেট সেক্টর থেকে পেশাগত জীবন শুরু করি। তবে ছোটবেলা থেকেই সিনেমার প্রতি ছিল এক অদম্য ভালোবাসা। ষষ্ঠ শ্রেণিতে প্রথম প্রেমের অভিজ্ঞতা আমাকে আবেগের নতুন জগতে নিয়ে যায়, সেখান থেকেই কবিতা লেখা শুরু। ধীরে ধীরে গান, গল্প লিখতে থাকি। আমার বাবা নিয়মিত গবেষণা ও লেখালেখি করতেন—তাকে দেখেই এতে অনুপ্রেরণা পাই। এ ধারাবাহিকতা আমাকে মিডিয়া ও সিনেমার জগতে টেনে আনে।

সিনেমার গল্প বাছাই করার সময় কোন বিষয়গুলোকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেন—দর্শক, সামাজিক বার্তা, নাকি নিজের শিল্পীজনিত স্বপ্ন?

জাহেদী: আমার কাছে গল্প নির্বাচন হলো তিন স্তরের বিষয়। প্রথমে দেখি দর্শকের আবেগ ছোঁয়া যাচ্ছে কি না। তারপর দেখি গল্পে সামাজিক বার্তা আছে কি না। আর তৃতীয়ত, চাই আমার নিজের শিল্পীস্বপ্নও প্রকাশ পাক। এ তিনটির সমন্বয়ই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

‘চলচ্চিত্র : দ্য সিনেমা’র মতো চরিত্রভিত্তিক গল্প বেছে নেওয়ার পেছনে ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতা বা দর্শন আছে?

জাহেদী: অবশ্যই আছে। আমি সব সময় মনে করি, প্রতিটি মানুষই একেকটা চলমান সিনেমা। তাদের আনন্দ, বেদনা, সংগ্রাম আমাকে গভীরভাবে টানে। তাই ‘দ্য সিনেমা’তে চরিত্রের ভেতরের দ্বন্দ্ব, ভালোবাসা, হারানো সময় আর পুনরুদ্ধারের চেষ্টা ফুটিয়ে তুলেছি।

আপনার কাজের মধ্যে কি কোনো সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা থিম পাওয়া যায়?

জাহেদী: আমার সিনেমায় মানুষ ও তার আবেগই মূল কেন্দ্র। বাস্তবতাবোধ থাকে, যাতে দর্শক নিজের জীবনকে খুঁজে পান। আর আমার গল্প বলায় কবিত্ব একটা বড় উপাদান—কবিতা দিয়েই তো শুরু হয়েছিল যাত্রা।

বাংলাদেশি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান অবস্থা আপনি কীভাবে দেখছেন?

জাহেদী: ইন্ডাস্ট্রি এখন পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম এক্সপেরিমেন্টাল ও কনটেন্ট–ড্রিভেন সিনেমা করছে। তবে সমস্যা আছে—পর্যাপ্ত হল নেই, আন্তর্জাতিক ডিস্ট্রিবিউশন দুর্বল, অনুদান প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ। সরকারের উচিত যোগ্য ও আধুনিক চিন্তাধারার নির্মাতাদের বাছাই করে অনুদান দেওয়া।

অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করার সময় আপনি কেমন সম্পর্ক বজায় রাখেন?

জাহেদী: আমি বিশ্বাস করি, পরিচালক আর অভিনেতা হলো এক দলের অংশ। চরিত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি, তাদের ভাবনা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগতে দিই। কেবল নির্দেশনা দিয়ে চরিত্র প্রাণবন্ত হয় না।

ভিজ্যুয়াল স্টাইল, শুটিং লোকেশন বা প্রযুক্তি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার বিশেষ কোনো নীতি আছে?

জাহেদী: এগুলো সবই গল্প বলার অংশ।

লোকেশন এমন হতে হবে, যা চরিত্রের জীবনের সঙ্গে খাপ খায়, আবার বাজেটও সামলানো যায়। প্রযুক্তি ব্যবহার করি তখনই, যখন তা গল্পকে শক্তিশালী করে।

নিজেকে আপনি কেমন ধরনের পরিচালক হিসেবে দেখতে চান?

জাহেদী: আমি নিজেকে রিয়েলিস্টিক ও আর্টিস্টিক গল্প বলার সেতুবন্ধনকারী মনে করি। কমার্শিয়াল দিক গুরুত্বপূর্ণ, তবে আমার লক্ষ্য দর্শকের মনে স্থায়ী ছাপ ফেলা।

আপনার জীবনের কোনো অভিজ্ঞতা কি পরিচালনার পদ্ধতি বদলে দিয়েছে?

জাহেদী: আমার প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘কাগজ’ আমার চিন্তাভাবনা বদলে দেয়। সেখানে চরিত্রের দর্শন ও জীবনবোধ নিয়ে কাজ করি। আর প্রচারণায় প্রথমবার টেরাকোটা পোস্টার ব্যবহার করি, যা এখন ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষিত।

রুনা খানকে নায়িকা করে আপনার নতুন সিনেমা নিয়ে কিছু বলুন।

জাহেদী: বর্তমানে আমরা পরিকল্পনার পর্যায়ে আছি। রুনা খান ছোটপর্দার পরিচিত মুখ হলেও, বড়পর্দায় তিনি নতুনভাবে ধরা দেবেন। চরিত্রকেন্দ্রিক এই সিনেমায় গানও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যেখানে নামী শিল্পীরা অংশ নিচ্ছেন। আমি বিশ্বাস করি, শক্তিশালী চরিত্র ও সৃজনশীল উপস্থাপনা থাকলে এটি ব্যবসায়িকভাবেও সফল হবে।

নায়িকা বাছাই নিয়ে কি কোনো বিতর্ক ছিল?

জাহেদী: কাস্টিং প্রক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেমন বিদ্যা সিনহা মিম গল্পটি পছন্দ করেছিলেন, তবে প্রযোজনাগত কারণে তাকে নেওয়া যায়নি। তবে এটা কোনো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, পুরোপুরি সৃজনশীল ও বাজেট সংক্রান্ত কারণে হয়েছে।

এই সিনেমার মাধ্যমে দর্শকদের কী বার্তা

দিতে চান?

জাহেদী: আমি চাই দর্শক অনুভব করুক—অন্ধকার যত গভীরই হোক, আশার আলো থাকে। একই সঙ্গে তারা যেন সমাজের বাস্তব সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবেন। আর হ্যাঁ, ছোট্ট একটি ভুলও কখনো মানুষের পুরো জীবন বদলে দিতে পারে।