জহির রায়হান, ১৯৭১ সালে ক্যামেরা হয়ে উঠেছিল রাইফেল
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ ভারতে আশ্রয় নেন। শরণার্থীদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের শিল্পী সমাজের একটা অংশ। তাঁদের বেশির ভাগই আশ্রয় নেন কলকাতায়। সেই সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন জহির রায়হান, সৈয়দ হাসান ইমামেরা। তাঁদের হাত ধরেই তৈরি হয় কয়েকটি তথ্যচিত্র, যা হয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের এক প্রামাণ্য দলিল।
নানা সীমাবদ্ধতায় প্রতিকূল পরিবেশে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি এবং পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রাঙ্গনের কয়েকজনের সহায়তায় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে জহির রায়হান, আলমগীর কবির ও বাবুল চৌধুরীর পরিচালনায় আরও তিনটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।
জহির রায়হানরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাওয়া চলচ্চিত্রশিল্পী ও কুশলীদের একত্রিত করতে ও সাহায্য করতে মে মাসের শেষ দিকে গঠন করেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি। সংগঠনটির সভাপতি হন জহির রায়হান, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ হাসান ইমাম, কোষাধ্যক্ষ আব্দুল জব্বার খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খসরু নোমান, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক উদয়ন চৌধুরী (ইসমাইল মোহাম্মদ)। সমিতির মূল কাজ ছিল পূর্ব বাংলা থেকে আসা চলচ্চিত্রশিল্পী ও কলাকুশলীদের খাদ্য, বাসস্থান ও মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা।
সমিতির সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগীত, নাটিকা, একাঙ্কিকা, বিচিত্রানুষ্ঠান করতেন। এ ছাড়া বিক্ষোভ মিছিল, কলকাতার বাইরে প্রচার-প্রচারণা, বেতার অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। কলকাতার চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন কেউ কেউ।
এ সমিতির শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন পরিচালক আব্দুল জব্বার খান, উদয়ন চৌধুরী (ইসমাইল মোহাম্মদ), জহির রায়হান, নারায়ণ ঘোষ মিতা, বাবুল চৌধুরী, ফজলুল হক, দিলীপ সোম; অভিনেতা ও পরিচালক সুভাষ দত্ত, সৈয়দ হাসান ইমাম, আমজাদ হোসেন; অভিনেতা আজমল হুদা মিঠু, জাফর ইকবাল, রাজু আহমেদ, দিলীপ বিশ্বাস, চাঁদ প্রবাসী, পরান বাবু, ফিরোজ ইফতেখার; অভিনেত্রী সুমিতা দেবী, সুচন্দা, কবরী প্রমুখ।
চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চারটি প্রামাণ্যচিত্র বানানো। মূলত এই সংগঠনের আর্থিক সহযোগিতায়ই চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতির সভাপতি জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘স্টপ জেনোসাইড’। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে প্রামাণ্যচিত্রটির কাজ শেষ হয়; সেপ্টেম্বরেই মুক্তি পায়। এটি বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনের পর ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেই সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার অন্যতম দলিল ছিল এটি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জনসমর্থন আদায়ে বড় ভূমিকা পালন করে প্রামাণ্যচিত্রটি। আক্ষরিক অর্ধেই ‘রাইফেল’ হয়ে উঠেছিল প্রামাণ্যচিত্রটি।
জেনে নেওয়া যাক তথ্যচিত্রগুলো সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য—
‘স্টপ জেনোসাইড’
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: জহির রায়হান
এ তথ্যচিত্রটির মাধ্যমে গণমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের শক্তিমত্তার পরিচয় পায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। তখন আলমগীর কবিরের মধ্যস্থতায় জহির রায়হানের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এম এন এ আব্দুল মান্নানের একটি বৈঠক হয়। ফলপ্রসূ এ বৈঠকে জহির রায়হানকে কয়েকটি চলচ্চিত্রের জন্য অর্থ বরাদ্দের কথা জানানো হয়।
আরও পাঁচ
এরপর জহির রায়হান পাঁচটি প্রামাণ্যচিত্র ও একটি কাহিনিচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা জমা দেন। পরিকল্পিত প্রামাণ্যচিত্রগুলো ছিল—‘অন দ্য ফ্রিডম ফাইটার্স’, ‘অন শেখ মুজিবুর রহমান’, ‘অন দ্য লিডার্স অব দ্য লিবারেশন মুভমেন্ট’, ‘টু মিলিয়ন ট্রেইটরস’, ‘লাইফ ইন লিবারেটেড এরিয়াজ অ্যান্ড অকুপাইড জোনস’ ও কাহিনিচিত্র ‘বার্থ অব আ নেশন’। এ পরিকল্পনায় বিশ মিনিট সময়সীমার ৪টি সাদা–কালো প্রামাণ্যচিত্রের প্রতিটির জন্য ১৫ হাজার টাকা ও দশ মিনিট সময়সীমার একটি সাদা–কালো প্রামাণ্যচিত্রের জন্য ৯ হাজার টাকা এবং এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট সময়সীমার রঙিন কাহিনিচিত্রটির জন্য ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়। সবগুলো চলচ্চিত্রই বাংলা, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় নির্মিত হবে বলে পরিকল্পনায় লেখা ছিল।
এই পরিকল্পনা প্রস্তাব পেয়ে মুজিবনগর সরকার জহির রায়হানকে তিনটি বিশ মিনিটের মুক্তিযুদ্ধ–সংক্রান্ত প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন।
নানা সীমাবদ্ধতায় প্রতিকূল পরিবেশে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি এবং পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রাঙ্গনের কয়েকজনের সহায়তায় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে জহির রায়হান, আলমগীর কবির ও বাবুল চৌধুরীর পরিচালনায় আরও তিনটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এর মধ্যে ‘আ স্টেট ইজ বর্ন’ চিত্রনাট্য, প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন জহির রায়হান। আলমগীর কবিরের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় তৈরি হয় ‘লিবারেশন ফাইটার্স’। বাবুল চৌধুরী পরিচালনা করেন ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’। যদিও বাকি দুটি প্রামাণ্যচিত্র জহির রায়হান নির্মাণ করেননি। তবে ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ ও ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’–এর প্রযোজক ছিলেন তিনি।
চারটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে যুক্ত ছিলেন চিত্রগ্রাহক অরুণ রায় ও সাধন রায়, সম্পাদনায় দেবব্রত সেনগুপ্ত ও ব্যবস্থাপনায় চিত্ত বর্ধনসহ আরও অনেক চলচ্চিত্রকর্মী। তাঁদের অক্লান্ত শ্রমের ফসল এই প্রামাণ্যচিত্রগুলো যেন হয়ে রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অনবদ্য দলিল।
আরও এক
এ প্রামাণ্যচিত্রগুলো ছাড়াও প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগ ১০ মিনিটের আরও একটি তথ্যচিত্র বানিয়েছিল বলে জানা যায়। যার পরিচালক ছিলেন আব্দুল জব্বার খান। চিত্রগ্রহণ করেন আসিফ আলী, সম্পাদনায় ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস।
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জহির রায়হান পরিচালিত ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘আ স্টেট ইজ বর্ন’, ও বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’ প্রামাণ্যচিত্রের ডিজিটাল সংস্করণ ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। তবে আলমগীর কবির পরিচালিত ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ তাদের সংগ্রহে নেই।
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ জার্নাল (২০২১)-এ মীর শামসুল আলমের লেখা ‘বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলীদের ভূমিকা’