‘সোহরাব রুস্তম’ সিনেমার আলোচিত নায়িকা বনশ্রীকোলাজ

বাসে বাসে হকারি, ফুল বিক্রি, আশ্রয়ণ প্রকল্পে আশ্রয়—নায়িকার নিঃসঙ্গ মৃত্যু

রুপালি পর্দার আলো নিভে গেছে অনেক আগেই। একসময় যিনি ছিলেন দর্শকের করতালির কেন্দ্র, যাঁর হাসি-অভিনয়ে ভরে উঠত সিনেমা হল, সেই বনশ্রীর জীবনের শেষ দৃশ্যটা ছিল নিঃসঙ্গতার মঞ্চে। শেষের দিনগুলোয় বাস্তব জীবনের পর্দায় দুঃখ–কষ্টই ছিল তাঁর স্থায়ী সহ-অভিনেতা। রোগশোকে জর্জরিত, তিনি হাসপাতালের এক কোণে বিদায় নিলেন নিঃশব্দে। পাশে ছিলেন না কোনো প্রযোজক, পরিচালক বা সহশিল্পী—ছিল কেবল একমাত্র ছেলে মেহেদী হাসান, ছোট ভাই হারুন শিকদারসহ আত্মীয়স্বজনের চোখের পানি। সন্ধ্যার পর নিঃশব্দে তাঁকে সমাহিত করা হয় নানাবাড়ির কবরস্থানে। আলো, ক্যামেরা, করতালির সেই সব দিন যেন ইতিহাস হয়ে রইল। আলো ঝলমলে জীবনের পর্দা নামে এক নিঃসঙ্গ, করুণ পরিসমাপ্তিতে।

বনশ্রীর ছোট ভাই পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান। ঢাকার মোহাম্মদপুরে থাকেন। বোনও প্রায় ভাইয়ের বাসায় থাকতেন। মাস দুয়েক তিনি ঢাকা ছাড়েন। বোন ঢাকা ছেড়ে শিবচর গেলেও ১৪ বছর বয়সী ছেলে মেহেদী হাসান মামার সঙ্গে মোহাম্মদপুরে বিজল্লী মহল্লার বাসায় থাকত। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টায় বনশ্রীর মৃত্যুর খবর শুনে ভাগনে মেহেদীকে নিয়ে ঢাকা থেকে শিবচরে ছুটে যান হারুন। ভাই যাওয়ার আগপর্যন্ত বনশ্রীর মরদেহ পড়ে ছিল শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এরপর বনশ্রীর মরদেহ নেওয়া হয় তাঁর নানাবাড়ি কুমিরপাড়ে। সেখানেই সমাহিত করা হয় তাঁকে।

হারুন জানান, বেশ কয়েক মাস ধরে তাঁর বোন বনশ্রী কিডনি, মস্তিস্ক, হার্টেরসহ নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। ঢাকার একাধিক হাসপাতালে কয়েক মাস ধরে চলে তাঁর চিকিৎসাসেবা। মাস দুয়েক আগে তিনি শিবচর যান। পাঁচ দিন আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিজে গিয়ে ভর্তি হন। কয়েক দিন ধরে চলে তাঁর চিকিৎসা। মঙ্গলবার সকালে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

নব্বইয়ের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের যে কয়েকটি মুখ দর্শকের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল, বনশ্রীও তাঁদের একজন। একসময় পর্দায় তাঁকে ছাড়া পূর্ণ হতো না অনেক সিনেমা। কিন্তু সময়ের নিষ্ঠুরতায় একসময় আলো থেকে ছিটকে পড়ে তিনি চলে যান অন্ধকারে। জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে এই নায়িকার জীবন হয়ে ওঠে সংগ্রাম, অনটন আর একাকিত্বের আরেক নাম।

১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সোহরাব-রুস্তম’ সিনেমার মাধ্যমে বনশ্রীর রুপালি পর্দায় আত্মপ্রকাশ। নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের বিপরীতে অভিনীত ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়। রাতারাতি পরিচিত হয়ে ওঠেন বনশ্রী। এরপর শুরু হয় তাঁর ব্যস্ত সময়। একে একে তিনি অভিনয় করেন ৮ থেকে ১০টি ছবিতে। নায়ক মান্না, রুবেল ও আমিন খানের সঙ্গে পর্দা মাতান তিনি। দর্শকেরা তাঁকে গ্রহণ করে নতুন প্রজন্মের নায়িকা হিসেবে। শুটিং সেট, গান, নাচ, ক্যামেরার ঝলকানি—সব মিলিয়ে তখন তাঁর জীবন রঙিন সিনেমার মতোই।

একটা সময় সিনেমায় অভিনয় ছেড়ে দেন বনশ্রী। তারপর শুরু জীবনের নতুন অধ্যায়, যে অধ্যায়ে এসে তিনি পড়েন অর্থকষ্টে। জীবনের এই কঠিন লড়াইয়ে একটা সময় সংসার চালাতে কষ্ট হয়। মাথা গোঁজার ঠাঁইও হারান।

২০১৪ সালে প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বনশ্রী জানিয়েছিলেন, একসময় শাহবাগে ফুল বিক্রির ব্যবসাও শুরু করেন। কিন্তু তা দিয়েও পুরোপুরি চলত না সংসার। শেষ পর্যন্ত তাঁকে নামতে হয় বাসে বাসে হকারির মতো কাজেও। সেই জীবনের গল্প এভাবেই বলেছিলেন বনশ্রী, ‘চলচ্চিত্র ছেড়ে দেওয়ার পরই আর্থিক অনটনে পড়ি। শাহবাগে ফুলের ব্যবসা করেছি। বাসে বাসে হকারিও করতে হয়েছে তিন বেলা খাবার জোগাড় করতে।’

শহুরে জীবনের চড়াই-উতরাই শেষে বনশ্রী ফিরে যান নিজ জেলা মাদারীপুরের শিবচরে। আশ্রয় মেলে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ছোট ঘরে। সরকারি অনুদান হিসেবে পাওয়া ২০ লাখ টাকার সুদই ছিল তাঁর একমাত্র ভরসা ছিল। একসময়ের নায়িকা তখন গ্রামে একা, খুব সাধারণ এক জীবন যাপন করতেন। খ্যাতি, করতালি, ক্যামেরার ঝলক—সব যেন অতীতের গল্প। প্রতিবেশীদের কাছে তিনি ছিলেন একসময়ের চলচ্চিত্রের নায়িকা বনশ্রী, কিন্তু তাঁর জীবনের কষ্টে কোনো আলোর রেশ দেখা যেত না।

১৯৭২ সালে শিবচরের মাদবরের চর ইউনিয়নের শিকদারকান্দি গ্রামে জন্ম বনশ্রীর। বাবা মজিবুর রহমান মজনু শিকদার ও মা সবুরজান রীনা বেগমের দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে বনশ্রী বড়। সাত বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে রাজধানী ঢাকায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন তিনি।