শেষ মুহূর্তে গোলের পর এনগুমোয়ার উচ্ছ্বাসরয়টার্স

লিভারপুলের হয়ে ইতিহাস গড়া কে এই ১৬ বছর বয়সী কিশোর

নিউক্যাসলের বিপক্ষে যোগ করা সময়ের ৬ মিনিটে কোডি গাকপোর বদলে মাঠে নামার সময় কী ভাবছিলেন রিও এনগুমোয়া? মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য মাঠে নেমে প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক নিশ্চয়ই তাঁর প্রত্যাশায় ছিল না। তা–ও এমন ম্যাচে, যেখানে তাঁর দল দুই গোলে এগিয়ে থাকার পরও লিড খুইয়ে পয়েন্ট হারানোর মুখে। তবে তারকা হতে চাইলে কিন্তু এটাই আবার আদর্শ ‘মঞ্চ’।

এনগুমোয়া ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই এখন যেন তারকা! গতকাল রাতে লিভারপুল–নিউক্যাসল ম্যাচের শেষ কয়েক মিনিট এনগুমোয়ার জন্যও হয়ে উঠেছিল ভাগ্যনির্ধারক। এমনও হতে পারত, এই কিশোর মাঠে নামার পর তেমন কিছুই আর হলো না। ম্যাচটাও ২–২ গোলে ড্রয়ে নিষ্পত্তি হয়ে যেত এবং ১৬ বছর বয়সী এই উইঙ্গারের প্রিমিয়ার লিগ অভিষেকও হয়ে যেত নীরবে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবশ্য এমনটাই হয়। কিন্তু এনগুমোয়া অভিষেকের গল্পটা লিখতে চাইলেন নিজের হাতে এবং লিখলেনও। মাঠে নামার ৪ মিনিটের মাথায় মোহাম্মদ সালাহর নিচু করে বাড়ানো বল দমিনিক সোবোসলাই ডামি করে ছেড়ে দিলে সেটি পেয়ে যান ফাঁকায় থাকা এনগুমোয়া। দারুণ এক শটে দূরের পোস্ট দিয়ে বল জালে জড়িয়ে হয়ে যান লিভারপুলের ৩–২ গোলে জয়ের নায়ক।

গোল করে ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেওয়ার পর থেকেই আলোচনার কেন্দ্রে এনগুমোয়া। ১৬ বছর ৩৬১ দিন বয়সে গোল করে দলকে জেতানোর পাশাপাশি রেকর্ডবইও তছনছ করেছেন এই কিশোর। লিভারপুলের ইতিহাসে সবর্কনিষ্ঠ গোলদাতার পাশাপাশি প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসে চতুর্থ সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতাও এনগুমোয়া। এ ছাড়া ওয়েইন রুনির পর ১৬ বছর বয়সে ম্যাচ জেতানো গোল করা দ্বিতীয় ফুটবলারও এই উইঙ্গার।

প্রিমিয়ার লিগ অভিষেকে ইতিহাস গড়া এনগুমোয়া কিন্তু আকস্মিকভাবে আবির্ভূত হওয়া কোনো তারকা নন। ১৬ বছর বয়সী কাউকে যখন প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মাঠে নামানো হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিতে হবে তিনি বিশেষ কেউ। দুর্দান্ত প্রতিভাবান কেউ না হলে এই বয়সী কারও এমন সময়ে মাঠে নামার প্রশ্নই আসে না। ফলে বিশেষ কেউ হিসেবে মাঠে নেমেই ইতিহাসটা লিখেছেন এনগুমোয়া।
যদিও এনগুমোয়ার ইতিহাস গড়ার কথা ছিল চেলসির হয়ে। নিউহামের (লন্ডনের পূর্বাংশ) ছেলে এনগুমোয়া মাত্র আট বছর বয়সে যোগ দিয়েছিলেন চেলসিতে।

‘ব্লুজ’দের খেলায়াড় তৈরির আঁতুড়ঘরে ২০১৬ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ছিলেন এবং সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা। চেলসির কোভহ্যাম ট্রেনিং গ্রাউন্ডে থাকা সবাই জানতেন এনগুমোয়া বিশেষ এক প্রতিভা। তাঁকে নিয়ে চেলসির সাবেক অধিনায়ক এবং একাডেমির সঙ্গে যুক্ত জন টেরি তখনই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘এনগুমোয়া হবে সেরা পর্যায়ের ফুটবলার।’

যে কারণে আট বছর পর এনগুমোয়া স্টামফোর্ড ব্রিজ ছাড়ার সময় ক্ষোভ ও হতাশা ছড়িয়ে পড়েছিল চেলসিতে। সে ক্ষোভ এতটাই তীব্র ছিল যে শোনা যায়, চেলসি নাকি লিভারপুলের স্কাউটদের তাদের একাডেমির ম্যাচে প্রবেশও নিষিদ্ধ করেছিল। বোঝাই যাচ্ছে, এনগুমোয়াকে হারানো চেলসির জন্য কতটা যন্ত্রণাদায়ক ঘটনা ছিল। গতকাল রাতের পর সেই ক্ষত নিশ্চয় নতুন করে পোড়াতে শুরু করবে চেলসি–সমর্থকদের।

আট বছর পর এনগুমোয়া স্টামফোর্ড ব্রিজ ছাড়ার সময় ক্ষোভ ও হতাশা ছড়িয়ে পড়েছিল চেলসিতে। সে ক্ষোভ এতটাই তীব্র ছিল যে শোনা যায়, চেলসি নাকি লিভারপুলের স্কাউটদের তাদের একাডেমির ম্যাচে প্রবেশও নিষিদ্ধ করেছিল।

চেলসি ছেড়ে গত বছর লিভারপুলে এলেও শুরুতে মূল দল থেকে দূরে রাখা হয়েছিল এনগুমোয়াকে। লিভারপুলের অনূর্ধ্ব-১৮ দল দিয়ে শুরু হয়েছিল যাত্রা। তবে দ্রুতই ঝলক দেখিয়ে চলে আসেন মূল দলের আলোচনায়। এফএ কাপে খেলা ৭২ মিনিটই ছিল গত মৌসুমে মূল দলের হয়ে তাঁর মাঠে নামার একমাত্র ঘটনা। ক্রিংটন স্ট্যানলির বিপক্ষে অ্যানফিল্ডের সেই ম্যাচে প্রথম একাদশে নাম লিখিয়ে অবশ্য ইতিহাসও গড়েছিলেন এনগুমোয়া—লিভারপুলের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ শুরুর কীর্তি।

ইতিহাস গড়ে শুরু করলেও এনগুমোয়া আর্নে স্লটের সামনে নিজেকে আলাদাভাবে চিনিয়েছেন প্রাক্‌–মৌসুম প্রস্তুতিতে। দলবদলে লিভারপুল প্রায় ৩০ কোটি পাউন্ড খরচ করে স্কোয়াড সাজালেও প্রস্তুতি পর্বে সবার চোখ ছিল এনগুমোয়ার ওপর। যেখানে ৫ ম্যাচে তিন গোল ও দুটি গোল করান।

তাঁর করা তিন গোলের দুটিই আবার এসেছিল একক নৈপুণ্যে। শুধু গোল বা সহায়তা করে নয়, তাঁর পারফরম্যান্সেও ছিল আত্মবিশ্বাসের ঝলক। বয়সের তুলনায় দারুণ বৈচিত্র্যময় এবং পরিপক্ব এই ফুটবলারকে আলাদাভাবেই নিজের হিসাবে রেখেছিলেন স্লট—যাঁকে নিউক্যাসলের বিপক্ষে তিনি ব্যবহার করেছেন তুরুপের তাস হিসেবে।

স্লটের লক্ষ্য লুইস দিয়াজ বায়ার্ন মিউনিখে যাওয়ার পর বাঁ দিকের ফরোয়ার্ড পজিশনে এনগুমোয়াকে ধীরে ধীরে তৈরি করে মূল দলে স্থায়ী করা, যা ভবিষ্যতের জন্য স্লটকে শক্তিশালী বিকল্পও দেবে। বিপরীতে এনগুমোয়া অপেক্ষায় ছিলেন সুযোগটা কাজে লাগানোর।

প্রাক্‌–মৌসুম প্রস্তুতিতে যখনই মাঠে নেমেছেন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। বিশেষ করে ইয়োকোহামা এফ মেরিনোস ও বিলবাওয়ের বিপক্ষে তাঁর দুর্দান্ত একক নৈপুণ্যের গোলই প্রমাণ করেছে তাঁর সামর্থ্য। সে সময় তাঁর সম্পর্কে সতীর্থ বেন ডোক বলেছিলেন, ‘ও সত্যিই অবিশ্বাস্য। সামনে তার জন্য বিশাল ক্যারিয়ার অপেক্ষা করছে। এত ক্ষুরধার ও প্রতিভাবান! যদি এভাবেই এগোতে পারে, তবে ওর পক্ষে যেকোনো কিছু সম্ভব।’

স্লট অবশ্য আরও একটি বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছিলেন। তাঁর চাওয়া ছিল ফন ডাইক ও সালাহদের মতো খেলোয়াড়দের কাছকাছি রেখে এনগুমোয়াকে তৈরি করবেন। প্রতি তিন দিনে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার জন্য কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়, সেটাও শেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে কিশোরই যে এভাবে মাঠে নেমে ইতিহাস বদলে দেবেন, এতটা বোধহয় ভাবতে পারেননি স্লট নিজেও। তবে বিশেষ প্রতিভারা তো এমনই। সব পরিকল্পনা ও অনুমানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের পাতাটাকে নতুন করে লেখাটাই তো তাঁদের কাজ।