রিয়াল মাদ্রিদ: নতুন মৌসুমের দলটা কেমন, কোথায় শক্তি, কোথায় দুর্বলতা
এই গ্রীষ্মটা আসলে রিয়াল মাদ্রিদের জন্য যেন পালাবদলের মৌসুম। কার্লো আনচেলোত্তির জায়গায় কোচ হয়েছেন জাবি আলোনসো। সঙ্গে যোগ হয়েছে একঝাঁক নতুন মুখ।
সাবেক মাদ্রিদ মিডফিল্ডার আলোনসোকে ডাগআউটে পেয়ে ক্লাবটির সমর্থকদের উচ্ছ্বাস যেন আকাশ ছুঁয়েছিল। তবে সেই আনন্দ কিছুটা ম্লান হয়ে যায় ক্লাব বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পিএসজির কাছে ৪–০ গোলে হারে। তবে সত্যিকার ‘আলোনসো–যুগ’ শুরু হচ্ছে আজ থেকে, লা লিগায় আজ বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় ওসাসুনাকে আতিথ্য দিয়ে রিয়াল শুরু করবে নতুন মৌসুম।
প্রত্যাশা আকাশছোঁয়া।
আলোনসোকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ দেওয়ার আগেই নতুন খেলোয়াড় কেনা থেকে শুরু করে স্কোয়াড পরিকল্পনার মতো অনেক সিদ্ধান্তে তাঁকে যুক্ত করা হয়েছিল। এটাই প্রমাণ করে ক্লাব কর্তৃপক্ষের তাঁর ওপর কতটা আস্থা। আগের কোচদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা পাচ্ছেন তিনি।
গত মৌসুমে কোনো বড় ট্রফি জেতেনি রিয়াল। ক্লাব বিশ্বকাপও হাতছাড়া হয়েছে। আলোনসোর কাছে তাই প্রাথমিক প্রত্যাশাই হচ্ছে লা লিগা আর চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা। এর কম যেকোনো কিছুতেই তাঁকে ব্যর্থ হিসেবে ধরা হতে পারে।
দলবদলে এই মৌসুমে দারুণ সক্রিয় রিয়াল। গত কয়েক বছর টাকা খরচে সংযমী ভাব এবার যেন উধাও।
চার খেলোয়াড় কিনতে খরচ হয়েছে ১৮ কোটি ইউরোরও বেশি। এর মধ্যে ১ কোটি খরচ হয়েছে ট্রেন্ট আলেকজান্ডার-আর্নল্ডকে নিতে। ইংলিশ ডিফেন্ডারকে আগেভাগে এনে ক্লাব বিশ্বকাপে খেলাতে রিয়াল এত মরিয়া ছিল যে লিভারপুলের সঙ্গে ৩০ জুন তাঁর চুক্তি শেষ হওয়া পর্যন্তও অপেক্ষা করেনি।
এ ছাড়া বোর্নমাউথ থেকে আনা হয়েছে স্প্যানিশ সেন্টারব্যাক ডিন হাউসেনকে (৫ কোটি ৮০ লাখ ইউরো), বেনফিকা থেকে ডিফেন্ডার আলভারো কারেরাস (৫ কোটি ইউরো), আর রিভার প্লেট থেকে আর্জেন্টাইন প্লে–মেকার ফ্রাঙ্কো মাস্তানতুয়োনোকে (৬ কোটি ৩০ লাখ ইউরো)।
এই তিনজনের বয়সই ২২-এর নিচে। মানে তরুণ প্রতিভার ওপরই বিনিয়োগ করছে রিয়াল, যেমনটা করেছিল জুড বেলিংহাম বা কামাভিঙ্গাকে কিনে।
মাঝমাঠে খেলোয়াড় খুঁজলেও কারও ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি রিয়াল। কিংবা সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
একাডেমির মিডফিল্ডার নিকো পাজকে গত বছর সিরি আ-র দল কোমোর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল রিয়াল। এবার তাঁকে ফেরত আনার কথা ভাবা হয়েছিল। মাত্র ৮০ লাখ ইউরো দিয়েই তাঁকে ফেরানো যেত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে, পাজের আরও সময় দরকার, আপাতত তিনি তাই ইতালিতেই থাকছেন। কোমোর সঙ্গে চুক্তিতে অবশ্য তাঁকে ২০২৭ বা ২০২৮ সালে ফেরানোর সুযোগ আছে।
মে মাসে এল ক্লাসিকোতে বার্সেলোনার কাছে মৌসুমের চতুর্থ হারের পর রিয়াল বোর্ড বলেছিল, ‘পরিবর্তনের সময় এসেছে।’
সেই ভাবনার ফলই হচ্ছে ৬৬ বছরের আনচেলোত্তির জায়গাটা আলোনসোকে দেওয়া। ক্লাব ছেড়েছেন দীর্ঘদিনের দুই আস্থা—৩৯ বছর বয়সী লুকা মদরিচ ও ৩৪ বছর বয়সী লুকাস ভাসকেস। এ দুজন মিলে জিতেছেন মোট ৫১টি ট্রফি।
আলোনসোর কোচিং স্টাফও নতুন। একাডেমিতেও পরিবর্তন এসেছে। কিংবদন্তি স্ট্রাইকার রাউল বিদায় নিয়েছেন কাস্তিয়ার কোচের দায়িত্ব থেকে। তাঁর জায়গায় নিয়েছেন আলোনসোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলভারো আরবেলোয়া। দুজন একসঙ্গে খেলেছেন রিয়াল আর লিভারপুলে। প্রকল্পটি শুধু কয়েক মাসের জন্য নয়, দীর্ঘমেয়াদি।
প্রাক্-মৌসুম বলতে ভালদেবেবাসে মাত্র দুই সপ্তাহের অনুশীলন আর একটি প্রস্তুতি ম্যাচ। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে হওয়া ক্লাব বিশ্বকাপই হয়ে গেছে মূল প্রস্তুতি।
বোর্নমাউথ থেকে কেনা হাউসেন রিয়াল সমর্থকদের নজর কেড়েছেন। তবে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছেন গঞ্জালো গার্সিয়া। কাস্তিয়ার হয়ে খেলা এই ২১ বছরের ফরোয়ার্ডের নাম এর আগে কেউ খুব একটা জানত না। কিন্তু বিশ্বকাপে ৪ গোল করে হয়েছেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন ২০৩০ পর্যন্ত নতুন চুক্তি।
আনচেলোত্তির খেলার ধরন নিয়ে সমালোচনা হচ্ছিল শেষ দিকে। আলোনসোর প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই বলেছেন, ‘আমি চাই আমার দলটা আবেগ আর প্রাণশক্তি ছড়িয়ে দিক সমর্থকদের মধ্যে, ওদের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করুক। এই মেলবন্ধনটাই হবে আমার দলের মূলমন্ত্র।’
সঙ্গে দিয়েছেন আক্রমণাত্মক ও উপভোগ্য খেলা উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও। মাঝেমধ্যেই বদলাবে কৌশল। তরুণদেরও দেওয়া হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। হাউসেন (২০), কারেরাস (২২) ও আর্দা গুলারকে (২০) নিয়ে তাই অনেক প্রত্যাশা সমর্থকদের।
রক্ষণ। গত মৌসুমে মাদ্রিদের জালে বল ঢুকেছিল ৮৪ বার—এর আগের মৌসুমের চেয়ে ৩৪ গোল বেশি। হাউসেন, আর্নল্ড ও কারেরাসের আগমন সেই সংখ্যা কমাতে পারে কি না, এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা। তবে এক মাস আগেই পিএসজির কাছে ৪–০ হারের ক্ষত এখনো শুকায়নি।
আরেকটা সমস্যা ছিল সামনের দিক থেকে প্রেসিং না করা। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র ও কিলিয়ান এমবাপ্পে আলোনসোর এই দাবি কতটা মেনে চলবেন, এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
আলোনসো নিজে বার্নাব্যুতে ছিলেন পাঁচ মৌসুম। কোচিং করিয়েছেন একাডেমিতেও। এই ক্লাবের সবকিছু তাঁর ভীষণ চেনা। এটা তাই ভালোই জানেন—রিয়াল মানে সব সময়ই আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা, রিয়াল মানে প্রতিদিন নিজেকে প্রমাণ করা, রিয়াল মানে প্রতিনিয়ত চাকরি হারানোর ভয়!
সব জেনেশুনে আলোনসো দায়িত্ব নিয়েছেন মানে তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে তৈরি। ক্লাবও তাঁর সঙ্গে ২০২৮ সালের গ্রীষ্ম পর্যন্ত চুক্তি করেছে। তাঁকে নিয়ে ক্লাবের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আঁচও পাওয়া যায় এ থেকে। হয়তো কয়েক ম্যাচ বা একটা মৌসুম খারাপ গেলেই হঠাৎ করে বিদায় করে দেওয়া হবে না তাঁকে।
হাঁটুর গুরুতর চোটের পর অধিনায়ক কারভাহাল ক্লাব বিশ্বকাপে মাত্র ১৯ মিনিট খেলেছেন। তারপরও রক্ষণে ডান পাশের মূল জায়গাটা হয়তো তাঁরই থাকবে। আর্নল্ড নেবেন অন্য কোনো ভূমিকা। বেলিংহাম কাঁধের অস্ত্রোপচারের করানোয় অক্টোবরের আগে ফিরতে পারছেন না। আপাতত তাঁর জায়গা নিতে পারেন গুলার বা মাস্তানতুয়োনো।
এ ছাড়া আলোনসো কোন ফরমেশন বেছে নেন, সেটা বুঝতে হলে রিয়ালের কয়েকটা ম্যাচ দেখতে হবে। নিজের দর্শন ও হাতে থাকা খেলোয়াড় বিবেচনায় রিয়ালের পরিচিত ফরমেশন থেকে বেরিয়েও আসতে পারেন। ক্লাব বিশ্বকাপেই যেমন দলকে খেলিয়েছেন তিন ডিফেন্ডারের ছকে।