ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ‘নৃত্যশিক্ষক’ হয়ে যুক্তরাজ্যে শাহরিয়ার
ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় আগ্রহ কম শাহরিয়ার হোসেনের। নিজে নাচতেন, শিশুদের দল বানিয়ে নাচ করতেন এলাকায়। এসব দেখে গ্রামের মানুষ নানা কটু কথা বলতেন। বাবা-মা চাইতেন ছেলেকে পড়ালেখায় মনযোগী করতে। কিন্তু পড়ার ফাঁকে সুযোগ পেলেই শাহরিয়ার ছুটতেন নাচের ক্লাসে। নিজের আগ্রহ আর চেষ্টায় নাচ শিখতে থাকেন। সেই নাচের কল্যাণেই যুক্ত্যরাজ্যে চাকরি নিয়ে যাচ্ছেন ২০ বছর বয়সী শাহরিয়ার। সেখানে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানে তাঁর পদ হচ্ছে ‘নৃত্যশিক্ষক ও কোরিও গ্রাফার’। এতে উচ্ছ্বসিত শাহরিয়ার ও তাঁর পরিবার।
শাহরিয়ার হোসেন ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার রাজীবপুর ইউনিয়নের উজানচর নওপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এমদাদুল হক ও জান্নাতুল ফেরদৌসী দম্পতির ছেলে। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয় শাহরিয়ার। মা এলাকায় একটি এনজিও পরিচালিত স্কুলে শিক্ষকতা করেন আর বাবা গাজীপুরে ব্যবসা করেন।
নাচ শেখার শুরুর বিষয়ে শহারিয়ার বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে যখন পড়েন, তখন থেকে টেলিভিশনে বিভিন্ন নাচের অনুষ্ঠান দেখে নিজেও নাচ আয়ত্ত করতে শুরু করেন।
ঘরের দরজা বন্ধ করে টিভিতে নাচ দেখে নাচার চেষ্টা করতেন। এটি জানাজানি হলে আশপাশের মানুষ অনেকে কটু কথা বলতেন। কিন্তু দাদা প্রয়াত গিয়াস উদ্দিন তাঁকে উৎসাহ দিতেন। মা ও বড় বোন নাচ নিয়ে কিছু না বললেও বাবা বকাবকি করতেন।
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় গফরগাঁও পৌর শহরে মামার বাসায় থেকে কোচিং করতেন। সেখানে মুক্ত পায়রা খেলাঘর একাডেমিতে সাজু সারের কাছ থেকে নাচ শেখেন। মাত্র ছয় মাসে লোকনৃত্য, ভরতনাট্যম ও কত্থক নৃত্য আয়ত্ত করেন। সেখানেই তাঁর নাচের হাতেখড়ি। এরপর শিশুশিল্পী হিসেবে ২০২০ সালে ময়মনসিংহ ছায়ানট থেকে সম্মাননা পান। এরপর নাচের প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে যায়।
কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবেও সফল
এলাকায় এসএসসি পাস করার পর ময়মনসিংহ কমার্স কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হন শাহরিয়ার। তিনি বলেন, ‘কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ময়মনসিংহের আঞ্চলিক কথা দিয়ে হাস্যরসের বিনোদনমূলক একটি পেজ খুলি, যার নাম দিই “ইমন ভাইয়ের রসের আলাপ”। কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে মাত্র ৮ মাসে ১ লাখ ২০ হাজার ফলোয়ার হয়, ভিডিও ভিউ হতে থাকে মিলিয়ন মিলিয়ন। কলেজের শিক্ষকেরাও আমার প্রতিভা সম্পর্কে জানতে শুরু করেন। কলেজের হয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি, অভিনয়সহ বিভিন্ন পারফর্ম করি। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-২০২৩–এ বিভাগীয় পর্যায়ে দলীয় নৃত্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করি, সেটার দলনেতা ছিলাম আমি। এতে উৎসাহ পেতে শুরু করি নিজের সহপাঠী ও শিক্ষকদের থেকে। স্বপ্ন বুনতে থাকি নিজের নাচ নিয়ে।’
এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল ভালো না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া নিয়ে চিন্তিত ছিলেন শাহরিয়ার। পড়ালেখার পাশাপাশি অর্জিত সহশিক্ষা কার্যক্রমের সনদের কল্যাণে ভর্তির সুযোগ পান ঢাকার বেসরকারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও নানাভাবে অনুপ্রেরণা জোগাতে থাকেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের দিনবদল অনুষ্ঠানে নিজে নাচ করার পাশাপাশি কোরিওগ্রাফি করা, একুশে টেলিভিশনে নাচ কোরিওগ্রাফি, উপস্থাপনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারফর্ম করার সুযোগ তৈরি হয়। নাচের বৃত্ত বড় হতে থাকে শাহরিয়ারের।
শাহরিয়ার হোসেন লোকনৃত্য, আধুনিক নাচ ও বেলি ডান্সে নিজেকে পারদর্শী করে তোলেন। এ জন্য কোনো ওস্তাদের দ্বারস্থ হননি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শিল্পীর নাচ দেখে দেখে নিজে কঠোর পরিশ্রম করে নাচের কঠিন সব ধাপ আয়ত্ত করেন বলে জানান শাহরিয়ার।
শাহরিয়ার বলেন, ভারতের এক বন্ধুর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের গ্লোবাল ট্যালেন্ট ভিসার কথা জানতে পারেন। তারপর অনলাইনে ঘাটাঘাটি করে দেখেন, ভিসা পেতে আইএলটিএস এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট প্রয়োজন হয় না। চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল অনলাইনে আবেদন করেন এবং নিজের বিভিন্ন নাচের ভিডিও পাঠান। এর ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম শহরের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘পারফেক্ট ইভেন্ট লালহাভেলি লিমিটেড’ নামের একটি কোম্পানি ২৮ মে স্পনসর দেয়। কোম্পানিটি নৃত্যশিক্ষক ও কোরিওগ্রাফার হিসেবে বছরে ৩৮ হাজার ৭০০ পাউন্ড (প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা) বেতন দেওয়ার কথা জানিয়েছে।
সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী মাসে কর্মস্থলে যোগ দিতে পারেন উল্লেখ করে শাহরিয়ার বলেন, ভিসার আবেদনপ্রক্রিয়া শেষে গত ২৯ জুলাই যুক্তরাজ্যের ই–ভিসার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। এরপর ২৩ আগস্ট তিনি ভিসা নিশ্চিত হওয়ার তথ্য জানতে পারেন। আগামী দুই বছরের জন্য এই ভিসা প্রদান করা হয়েছে।
শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি শুধু বলব, পড়াশোনার পাশাপাশি যার যা আগ্রহ, সেটাকেই নিজের শক্তি বানাতে পারো। আমি প্রমাণ করেছি, গ্রামের ছেলে হয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে জায়গা করে নেওয়া সম্ভব। আমরা সাধারণত শুধু স্টুডেন্ট বা ওয়ার্ক ভিসা নিয়ে ভাবি, কিন্তু ক্রিয়েটিভ ভিসা ও গ্লোবাল ট্যালেন্ট ভিসার মতো অপশনও রয়েছে—যেগুলোর খবর অনেকেই জানে না। নিজেকে গড়ে তুললে এসব সম্ভাবনার দরজা খুলে যায়।’
শহারিয়ারের মা জান্নাতুল ফেরদৌসী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই শাহরিয়ার পড়ালেখায় আগ্রহী কম ছিল। দল বেঁধে নাচত, এ জন্য মানুষ নানা কথা শোনাত আমাকে। তার বাবা এই নাচ সহ্য করতে পারত না। একমাত্র ছেলে হওয়ায় আমিও তাকে বেশি বাধা দিইনি। আজ সে নাচ দিয়েই দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। এটি আমাদের জন্য খুব আনন্দের। আসলে যে যেটা করতে চায়, তাকে সেটা করতে দেওয়া উচিত।’