পর্দায় কোরিয়ার প্রথম প্রাপ্তবয়স্কদের সিনেমার গল্প, ভাইরাল অন্তরঙ্গ দৃশ্য
দক্ষিণ কোরিয়ায় তখন স্বৈরতন্ত্র। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, সব স্বৈরতন্ত্রেই যেমন হয়। তবে স্বৈরাচারের সেই যৌনতা নিয়ে কোনো ছুঁতমার্গ ছিল না; বরং যৌনতাকে পুঁজি করেই ব্যবসা করতে চেয়েছেন। সেই সময়ে তৈরি হয়েছিল কোরিয়ার প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক সিনেমা ‘মাদাম এমা’। ব্যাপক আলোচিত সিনেমাটি নির্মাণের গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে নেটফ্লিক্সের ছয় পর্বের সিরিজ ‘এমা’; ২২ আগস্ট মুক্তির পর থেকেই যা ব্যাপকভাবে আলোচনায়।
এক ক্লান্ত অভিনেত্রী; এক লোভী ও নারীবিদ্বেষী প্রযোজক; এক নবিশ পরিচালক; আর এক উচ্চাভিলাষী নাইট ক্লাব নর্তকী—যাঁরা মিলে তৈরি করতে চান কোরিয়ার প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক চলচ্চিত্র। মোটাদাগে এই হলো সিরিজটির গল্প।
১৯৮২ সালের ‘মাদাম এমা’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন আন সো-ইয়ং। ছবির একটি দৃশ্যে ঘোড়ার পিঠে নগ্ন অবস্থায় দেখা যায় তাঁকে। দৃশ্যটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। সিনেমাটি বাণিজ্যিকভাবে বিরাট সাফল্য পায়—শুধু সিউলেই এক লাখের বেশি টিকিট বিক্রি হয়। পরে এটি ১২টি সিক্যুয়েল, অসংখ্য স্পিন-অফ আর রিমেকের জন্ম দেয়। চলচ্চিত্রটির নাম রাখা হয়েছিল ইউরোপ ও জাপানের জনপ্রিয় প্রাপ্তবয়স্ক সিনেমার ধাঁচে—ফরাসি ‘ইমানুয়েল’-এর অনুকরণে।
যদিও চরিত্র ও ঘটনাগুলো অনেকটাই কাল্পনিক, গল্পটির শিকড় রয়েছে বাস্তব ইতিহাসে। ‘এমা’ সরাসরি অনুপ্রাণিত ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কোরিয়ার প্রথম ইরোটিক সিনেমা ‘মাদাম এমা’ থেকে। আর সেই সঙ্গে সিরিজটি তুলে ধরে সামরিক এক নায়ক চুন দু-হুয়ানের সময়কার কঠোর বাস্তবতা।
যখন কোরিয়া ১৯৮৮ সালের সিউল অলিম্পিকের আগে ‘আধুনিকায়ন’ আর দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে এগোচ্ছিল, অথচ ভেতরে লুকানো ছিল রাজনৈতিক দমন-পীড়নের করুণ ইতিহাস।
গল্পে কী দেখানো হয়েছে?
সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্র জং হি-রান (অভিনয়ে লি হা-নি, যাকে আন্তর্জাতিক ভক্তরা হানি লি নামেও চেনেন)। কোরীয় সিনেমায় নগ্নতার জন্য পরিচিত এই অভিনেত্রী বারবার একই ধাঁচের যৌন আবেদনময়ী চরিত্রে অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত। নতুন ছবি ‘মাদাম এমা’র প্রস্তাব পেয়ে তিনি ঘোষণা দেন, আর কোনো নগ্ন দৃশ্যে অভিনয় করবেন না।
১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত কোরিয়ার সামরিক শাসক ছিলেন চুন দু-হুয়ান। ক্ষমতায় আসার পর গণতন্ত্রকামী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে নির্মমভাবে গওয়াংজু হত্যাযজ্ঞ ঘটান, যেখানে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হন।
এতে খেপে যান প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কর্তা কু জং-হো। তিনি নতুন মুখ শিন জু-এ-কে (অভিনয়ে নবাগত বাং হ্যো-রিন) নিয়ে আসেন প্রধান চরিত্রে। হি-রানের আদর্শ-মানসিকতায় ভর করে জু-এ নিজের স্বপ্নপূরণের পথ খুঁজতে থাকেন। শুরুতে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হলেও পরে তাঁরা বুঝতে পারেন, পুরুষশাসিত চলচ্চিত্রশিল্পে টিকে থাকতে তাঁদের একে অপরের সহযোগী হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
‘চুংমুরো: কোরিয়ার হলিউড’
‘এমা’র অনেক ঘটনাই ঘটেছে চুংমুরোতে; এটি সিউলের কেন্দ্রীয় এক সড়ক, যা কোরিয়ান চলচ্চিত্রশিল্পের ঐতিহাসিক কেন্দ্র। কফিশপ, রেস্তোরাঁ, ক্যামেরার দোকান আর ছাপাখানায় সরব ছিল এই অঞ্চল। এখানেই ১৯০৭ সালে গড়ে ওঠে দানসুংসা-কোরিয়ার প্রথম সিনেমা হল। নব্বইয়ের দশকে গণতন্ত্রায়ণ আর নতুন ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযোজনা সংস্থাগুলো গ্যাংনাম এলাকায় চলে গেলেও আজও ‘চুংমুরো’ শব্দটা কোরিয়ান সিনেমার প্রতিশব্দ।
সেন্সরশিপ আর একনায়ক চুন দু-হুয়ানের ‘৩এস’ নীতি
১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত কোরিয়ার সামরিক শাসক ছিলেন চুন দু-হুয়ান। ক্ষমতায় আসার পর গণতন্ত্রকামী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে নির্মমভাবে গওয়াংজু হত্যাযজ্ঞ ঘটান, যেখানে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হন।
একদিকে সহিংস দমননীতি, অন্যদিকে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য চালু করেন তথাকথিত ‘৩এস’ নীতি—সেক্স, স্ক্রিন আর স্পোর্টস। এর ফলে কোরিয়ায় জন্ম নেয় ইরোটিক চলচ্চিত্রের নতুন ধারা। ‘মাদাম এমা’ ছিল সেই নীতির আওতায় তৈরি প্রথম চলচ্চিত্র।
অদ্ভুতভাবে সরকার যৌনতাকে উৎসাহিত করলেও রাজনৈতিক সমালোচনা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। সিরিজটির পরিচালক লি হে-ইয়ং বলেন, ‘আশির দশকে একদিকে যৌনতা উৎসাহিত হচ্ছিল, অন্যদিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রায় ছিল না। আজকের দৃষ্টিতে সেই বৈপরীত্য আবার তুলে ধরতে চেয়েছি।’
‘মাদাম এমা’
১৯৮২ সালের ‘মাদাম এমা’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন আন সো-ইয়ং। ছবির একটি দৃশ্যে ঘোড়ার পিঠে নগ্ন অবস্থায় দেখা যায় তাঁকে। দৃশ্যটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। সিনেমাটি বাণিজ্যিকভাবে বিরাট সাফল্য পায়—শুধু সিউলেই এক লাখের বেশি টিকিট বিক্রি হয়। পরে এটি ১২টি সিক্যুয়েল, অসংখ্য স্পিন-অফ আর রিমেকের জন্ম দেয়।
চলচ্চিত্রটির নাম রাখা হয়েছিল ইউরোপ ও জাপানের জনপ্রিয় প্রাপ্তবয়স্ক সিনেমার ধাঁচে—ফরাসি ‘ইমানুয়েল’-এর অনুকরণে।
বাস্তব আর কল্পনার মিশেল
‘এমা’ সরাসরি ঐতিহাসিক ডকুমেন্টারি নয়; বরং বাস্তব ইতিহাসকে ভিত্তি করে কল্পিত চরিত্রের ভেতর দিয়ে দেখানো হয়েছে আশির দশকের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা।
পরিচালক লি বলেন, ‘“মাদাম এমা” সেই সময়ের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ছিল। কিন্তু যারা সেই নামের সঙ্গে বেঁচেছিলেন, তাঁদের প্রতিদিন লড়তে হতো বৈষম্য আর ভুল–বোঝাবুঝির বিরুদ্ধে। আমি চেয়েছি, তাঁদের সহনশীলতার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে।’
পরিচালক লি আরও যোগ করেন, ‘যত বেশি ঝলমলে দৃশ্যপট, তত স্পষ্ট হয় যে যুগটা ছিল শোষণ আর দমন-পীড়নের। সেই দ্বৈত সত্যই “এমা”কে তৈরি করেছে।’
এই নির্মাতা আরও জানান, সিরিজটি দিয়ে তিনি সেই সময়ের নিগৃহীত নারীদের শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘এমা ছিল এমন একজন, যে ১৯৮০ দশকের সময়ের আকাঙ্ক্ষা আর সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেছিল। কিন্তু সেই সময় এমা হয়ে বেঁচে থাকা মানে ছিল অবিরাম পক্ষপাত, হিংস্র ভুল-বোঝাবুঝি আর সমাজের কটূক্তির মুখোমুখি হওয়া। তাই এই গল্প যখন আমি ভেবেছি, তখন সেটিকে দেখেছি তাঁদের সহনশীলতা ও সংগ্রামের কণ্ঠস্বর হিসেবে।’
আজকের দর্শকের কাছে প্রাসঙ্গিকতা
আশির দশকের গল্প হলেও ‘এমা’ আজকের দর্শকের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কোরিয়ার মতো আধুনিক সমাজেও ক্ষমতার বৈষম্য, লোভ আর নারীর প্রতি শোষণ এখনো একইভাবে বিদ্যমান।
পরিচালকের ভাষায়, ‘আমরা ১৯৮০ সালের গল্প বলছি; কিন্তু ভেতরে-ভেতরে সেটা আজকের পৃথিবীর প্রতিফলন। আজও এমন অনেক স্বৈরাচার আছেন, যাঁরা ভাবেন ব্যবসা সফল হলেই সবকিছু ন্যায্য হয়ে যায়।’
সিরিজটি কেন গুরুত্বপূর্ণ
‘মাদাম এমা’ শুধু একটি সিনেমা নয়, আশির দশকের সামাজিক চাপ, নারীবিদ্বেষ আর ক্ষমতার খেলার প্রতিচ্ছবি। নেটফ্লিক্সের এমা সেই গল্পকেই আজকের দর্শকের কাছে নতুনভাবে হাজির করেছে।
আশির দশককে সাধারণত কোরিয়ান রাজনৈতিক সিনেমায় দেখা যায় ধূসর ও ভারী আবহে। কিন্তু ‘এমা’ উল্টো পথে হেঁটেছে। ঝলমলে ফ্যাশন, উজ্জ্বল রং আর প্রাণবন্ত আবহে সাজানো সিরিজটি যেন চুংমুরোর জাঁকজমকপূর্ণ জগৎকে আবার জীবন্ত করে তোলে। তবুও সেই আড়ম্বরের নিচে লুকিয়ে থাকে নারীদের যন্ত্রণা। মুখে হাসি, সাজগোজের আড়ালে তাঁরা লুকিয়ে রাখতেন অপমান, বৈষম্য আর শোষণের ক্ষতচিহ্ন। সিরিজটি দেখায়, কীভাবে নারীরা টিকে থাকার জন্য বারবার আপস করলেও ভেতরে-ভেতরে লড়াই চালিয়ে গেছেন।
বিতর্ক
সিরিজের কিছু জায়গায় বিতর্কও তৈরি করেছে। কারণ, যৌন আকাঙ্ক্ষাকে এখানে প্রায় সব সময় নেতিবাচকভাবে দেখানো হয়েছে। একজন নারী চরিত্র যৌন সম্পর্ককে ‘লেনদেন’ হিসেবে ব্যবহার করলে শেষ পর্যন্ত তাঁকেই নির্মম শাস্তির মুখে পড়তে হয়। ফলে মুক্তচিন্তার বদলে সিরিজটি কিছুটা রক্ষণশীল দিকেই ঝুঁকেছে। সিরিজটির চরিত্র বা ঘটনাগুলোর বেশির ভাগই কাল্পনিক। ফলে ‘এমা’ অনেক সময় ঐতিহাসিক সত্য নয়; বরং ভিজ্যুয়াল আনন্দ আর নাটকীয়তা দেখাতেই বেশি মন দিয়েছে।
কী বলছেন সমালোচকেরা
মুক্তির পর থেকে বেশির ভাগ সমালোচকই ‘এমা’র প্রশংসা করেছেন। সিরিজটির গড় রেটিং ৫-এ ৩.৫। সিরিজের প্রধান অভিনয়শিল্পী ও নির্মাণের তারিফ করেছেন তাঁরা। অনলাইন গণমাধ্যম ‘ডিসাইডার’ সিরিজটি নিয়ে লিখেছে, ‘প্রথম পর্বেই ঠিক সুরটি ছুঁয়ে দিয়েছে “এমা”। শুরু থেকেই যেন পরিষ্কার, এটি কেবল একটি সেই সময়ের গল্প নয়; বরং এক তারকা ও এক নবাগত অভিনেত্রীর আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের কাহিনি।’
সিরিজটি নিয়ে গণমাধ্যমটি আরও লিখেছে, ‘এটা মাস্টারপিস হয়, তবে এতটুকু বলতে পারি, খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সামান্য কিছু ঘষামাজা করলে সিরিজটি অন্য উচ্চতায় পৌঁছাতে পারত।’
মুক্তির পর থেকে আলোচনায় আছে সিরিজটি, ‘এমা’ কিছু অন্তরঙ্গ দৃশ্য আলাদাভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। মুক্তির এক সপ্তাহও পার হয়নি, সময় যত গড়াবে, নিশ্চিতভাবেই ‘এমা’ নিয়ে আলোচনা আরও বাড়বে।
তথ্যসূত্র: টাইম, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট