সাগরে রহস্যময় ঢেউ হওয়ার কারণ কী
১৯৭৮ সালের ১২ ডিসেম্বর উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে নিখোঁজ হয়েছিল ৮৫০ ফুট দীর্ঘ কার্গো জাহাজ এম এস মুনচেন। নিখোঁজ হওয়ার ঠিক আগে বিশাল জাহাজটি থেকে বিপৎসংকেত পাঠানো হয়েছিল। ধারণা করা হয়, কোনো এক দানবীয় শক্তির আঘাতে জাহাজটির ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এরপর প্রায় ৩০ ঘণ্টা ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে ২৮ জন নাবিকসহ সমুদ্রে ডুবে যায় জাহাজটি। এরপর আর কখনো সেই বিশাল জাহাজের আর খোঁজ মেলেনি। ১৯৮০ সালেও ৯৬৪ ফুট দীর্ঘ ব্রিটিশ কার্গো জাহাজ এমভি ডার্বিশায়ার দক্ষিণ চীন সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে ডুবে যায়। সে সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ডুবে যাওয়া সবচেয়ে বড় জাহাজ ছিল সেটি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, দুটি জাহাজই বিশেষ ধরনের ঢেউয়ের আঘাতে ডুবে গেছে। এসব ঢেউ পার্শ্ববর্তী ঢেউয়ের তুলনায় অন্তত দুই গুণ বড় হয়ে উঁচু চূড়া ও গভীর ঢাল তৈরির পাশাপাশি কয়েক মিনিটের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যায়। রহস্যময় এ ঢেউ কেন ও কীভাবে তৈরি হয়, তা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো অজানা।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, সাগরে চারপাশ থেকে আসা ঢেউ বিভিন্ন গতিতে একত্র হয়ে পানিতে বিশাল প্রাচীর তৈরি করে। আবার অনেক সময় ছোট ছোট ঢেউ তাদের সব শক্তি একটি একক বড় ঢেউয়ে স্থানান্তরিত করে এমন রহস্যময় ঢেউ তৈরি করে। বায়ুপ্রবাহ এই ধরনের ঢেউ তৈরির একটি মূল কারণ। বাতাস যখন বায়ুমণ্ডলের শক্তিকে পানির পৃষ্ঠে স্থানান্তরিত করে, তখন এমন ঢেউ তৈরি হয়। বাতাস যত শক্তিশালী হয় সমুদ্র তত বেশি বিক্ষুব্ধ হবে। তখন চরম ঢেউ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। হঠাৎ করে তৈরি হওয়ায় এ ধরনের ঢেউ যেকোনো জাহাজের জন্য বড় হুমকি। ১৯৯০–এর দশকের পর জাহাজের নকশা উন্নত হলেও এসব ঢেউ এখনো বেশ হুমকিস্বরূপ।
সমুদ্রে রহস্যময় ঢেউ তৈরির পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা আছে কি না, তা জানতে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। এ বিষয়ে জাপানের ওকিনাওয়া ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির মেরিন ফিজিকস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান আমিন চাবচৌব বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাতাসের গতি বাড়াচ্ছে। বাতাস যেহেতু ঢেউ তৈরি করে তাই জলবায়ু পরিবর্তন ও খারাপ ঢেউয়ের মধ্যে একটি প্রাকৃতিক সংযোগ থাকতে পারে।’ ২০১৯ সালে একটি ব্রিটিশ গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে এমন ঢেউয়ের উচ্চতা বছরে ১ শতাংশ হারে বাড়ছে। শক্তিশালী বাতাস বড় ঢেউ তৈরি করছে। পুরো বিষয়টি বেশ জটিল। বিভিন্ন ঢেউ স্রোতের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। বিভিন্ন স্রোত আবার বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আলেসান্দ্রো তোফোনি ২০১৭ সালে দক্ষিণ মহাসাগরে একটি অভিযানে গিয়ে প্রতি ছয় ঘণ্টায় এমন ঢেউ তৈরি হতে দেখেছেন। এসব ঢেউ পাশের ঢেউয়ের চেয়ে দুই গুণ লম্বা। ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার অব ওশান ইনফরমেশন সার্ভিসেসের গবেষক স্বর্ণালি মজুমদার ও পরিচালক বালাকৃষ্ণান নায়ার ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে ৫৫টি এমন ঢেউয়ের ঘটনা শনাক্ত করেছেন।
বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে রহস্যময় এসব ঢেউ শনাক্ত করতে চান। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের গবেষকেরা গত বছর একটি এআই টুল চালু করেছেন। এই টুল ঢেউ আসার প্রায় ৫ মিনিট আগে আগাম সতর্কতা দিতে পারে। এই টুল তৈরি করতে ১৭০টিরও বেশি ভাসমান বয়ার তথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ফ্রান্সেসকো ফেডেলে বলেন, এআই দুষ্টু ঢেউয়ের পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া