খেলাধুলাকেও রাজনৈতিক এজেন্ডার হাতিয়ার

খেলাধুলাকেও রাজনৈতিক এজেন্ডার হাতিয়ার

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন পরিকল্পনা হলো— প্রেসিডেন্সিয়াল কাউন্সিল অন স্পোর্টস, ফিটনেস অ্যান্ড নিউট্রিশন আবার ফিরিয়ে আনা এবং এর সঙ্গে ফিরতে পারে বহুদিনের পুরোনো প্রেসিডেন্সিয়াল ফিটনেস টেস্ট।

বলা হচ্ছে, এটি আমেরিকান তরুণদের হাত থেকে ফোন নামিয়ে আবার শারীরিক অনুশীলনে ফিরিয়ে আনার জন্য চালু করা হচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে এটিকে রাজনৈতিক চাল হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।

এই কাউন্সিলে যুক্ত হয়েছেন তারকা ক্রীড়াবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা—হকি কিংবদন্তি ওয়েন গ্রেটস্কি, গলফার ব্রাইসন ডি শ্যাম্বো, বেসবল তারকা মারিয়ানো রিভেরা, এনএফএল (ন্যাশনাল ফুটবল লিগ) কমিশনার রজার গুডেল, এনএইচএল (ন্যাশনাল হকি লিগ) কমিশনার গ্যারি বেটম্যান এবং এমনকি ডব্লিউডব্লিউই (WWE) সুপারস্টার থেকে নির্বাহী হওয়া ‘ট্রিপল এইচ’ পর্যন্ত।

ট্রাম্প বরাবরই পেশাদার খেলাধুলার অংশ হতে পছন্দ করেন। তবে তার অংশগ্রহণ আর শুধু ফটোসেশন বা মঞ্চস্থ বিনোদনে সীমাবদ্ধ নেই—যেমনটা দেখা গিয়েছিল ২০০৭ সালে রেসলম্যানিয়ায় ভিন্স ম্যাকমাহনকে নাটকীয়ভাবে ফেলে দেওয়ার সময়। এখন তিনি খেলাধুলার মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। ওয়াশিংটন কমান্ডার্স এবং ক্লিভল্যান্ড গার্ডিয়ান্সকে তাদের পুরোনো নাম ফিরিয়ে আনার দাবি থেকে শুরু করে, পিট রোজকে বেসবলের হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত করার বিতর্কে সরাসরি হস্তক্ষেপ—ট্রাম্প যেন নিজেকে তুলে ধরছেন আমেরিকার ‘কমান্ডার ইন চিফ অব স্পোর্টস’ হিসেবে।

ক্রীড়া বিতর্কে ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ

১৯৮৯ সালে জুয়া–কেলেঙ্কারির কারণে বেসবল থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হন পিট রোজ। গত সেপ্টেম্বরে ৮৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান। কিন্তু সম্প্রতি এমএলবি (মেজর লিগ বেসবল) কমিশনার রব ম্যানফ্রেড ঘোষণা দেন—যারা মারা গেছেন, তাদের ক্ষেত্রে আজীবন নিষেধাজ্ঞা আর প্রযোজ্য নয়। এর ফলে রোজ ২০২৭ সালের ডিসেম্বরেই হল অব ফেমে বিবেচনার আওতায় আসতে পারেন। ম্যানফ্রেড নিজেই স্বীকার করেছেন, এই নীতি বদল আনার পেছনে ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে হওয়া বৈঠক প্রভাব ফেলেছিল।

এ নিয়ে ক্রীড়া সম্প্রচারক বব কস্টাস বলেন, ‘এটা ভাবা যৌক্তিক যে, সেই বৈঠকে আসলে কী আলোচনা হয়েছিল, আর প্রেসিডেন্ট কেবল মতামত জানানো ছাড়াও কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করেছিলেন কি না। ’

ট্রাম্প বিতর্কিত ক্রীড়া–মন্তব্যে নতুন নন। প্রথম মেয়াদে এনএফএল খেলোয়াড়রা যখন কলিন ক্যাপারনিকের পথ অনুসরণ করে জাতীয় সঙ্গীত চলাকালে হাঁটু গেড়ে বর্ণবাদ ও পুলিশি সহিংসতার প্রতিবাদ করছিলেন, তখন তিনি সরাসরি বলেছিলেন, ‘ওই হারামজাদাকে মাঠ থেকে বের করে দাও, এখনই। সে বরখাস্ত!’

দ্বিতীয় মেয়াদে এসে ট্রাম্পের অংশগ্রহণ আরও সুসংগঠিত হয়েছে। তার ক্রীড়া–অভ্যাস এখন তিনভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে:

- হোয়াইট হাউসে চ্যাম্পিয়ন দল ও ক্রীড়া তারকাদের আমন্ত্রণ।
- বড় ক্রীড়া আসরে নিজে উপস্থিত থেকে আলোচনায় থাকা।
- খেলাধুলাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক এজেন্ডা ও সাংস্কৃতিক লড়াই সামনে আনা।

হোয়াইট হাউস সফর ও বদলে যাওয়া সংস্কৃতি

খেলোয়াড়দের হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ দীর্ঘদিন ধরে একটি ঐতিহ্য। কিন্তু একবিংশ শতকে রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে অনেকেই আমন্ত্রণ বর্জন করতে শুরু করেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি পাল্টেছে। ২০২৪ সালের ওয়ার্ল্ড সিরিজজয়ী লস অ্যাঞ্জেলেস ডজার্স যখন হোয়াইট হাউসে যায়, পুরো দলই উপস্থিত ছিল। এমনকি মুকি বেটসও, যিনি ২০১৯ সালে রেড সক্সের হয়ে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সফর বর্জন করেছিলেন। এবার তিনি বলেন, ‘এটা রাজনৈতিক ব্যাপার নয়। আগেরবার আমি স্বার্থপরতার কারণে যাইনি.’

সমাজবিজ্ঞানী ড. হ্যারি এডওয়ার্ডসের মতে, ষাটের দশকে কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাথলেটদের আন্দোলন যেমন প্রভাব ফেলেছিল—জিম ব্রাউন, বিল রাসেল, মোহাম্মদ আলি কিংবা ১৯৬৮ সালের অলিম্পিকে টমি স্মিথ ও জন কার্লোসের মুষ্টিবদ্ধ প্রতিবাদ—এখন তেমন কোনো আন্দোলন নেই। ফলে খেলোয়াড়দের হোয়াইট হাউস সফর এখন আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব হিসেবেই দেখা হয়।

বড় ইভেন্টে ট্রাম্পের উপস্থিতি

ট্রাম্প সম্প্রতি মেটলাইফ স্টেডিয়ামে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ ফাইনালে হাজির হয়েছিলেন। চেলসির হাতে ট্রফি তুলে দেন, যদিও দর্শকদের কাছ থেকে কিছুটা বিদ্রূপও শুনতে হয়েছে। এর আগেও প্রেসিডেন্টরা বড় ক্রীড়া আসরে গিয়েছেন—২০০১ সালের ৯/১১–এর পর জর্জ ডব্লিউ বুশের ওয়ার্ল্ড সিরিজে প্রথম বল ছোড়া ছিল জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।

কিন্তু ট্রাম্প শুধু প্রতীকী উপস্থিতি চান না। আসন্ন ২০২৬ বিশ্বকাপ (যা যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডায় অনুষ্ঠিত হবে) এবং ২০২৮ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক ঘিরে তিনি হতে যাচ্ছেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

ক্লাব বিশ্বকাপের শুরুতে জুভেন্টাসের খেলোয়াড়দের হোয়াইট হাউজে ডেকে এনে নিজের প্রচার করেছেন ট্রাম্প। এরপর ফাইনালে ট্রফি তুলে দিতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিও তৈরি করেন তিনি। খেলোয়াড়রা শিরোপা নিয়ে উদযাপন করার সময় সেখানে অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন।

ক্লাব বিশ্বকাপের একটি রেপ্লিকা ওভাল অফিসে সাজিয়ে রেখেছেন তিনি। আর গতকাল ২০২৬ বিশ্বকাপের ড্র অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়ার সময়ও বিশ্বকাপের রেপ্লিকা নিজের কাছে রেখে দাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি। এর আগে ফিফা প্রেসিডেন্টকে সঙ্গে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য সফর করে এসেছেন তিনি। সেটা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।

ক্রীড়ায় ব্যবসা ও নতুন পরিকল্পনা

গলফে ট্রাম্পের প্রভাব সুপরিচিত। তিনি লিভ গলফ ও পিজিএ ট্যুরের সম্ভাব্য একীভূতকরণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। দাবি করেছেন, ‘এটা করতে আমার ১৫ মিনিটই যথেষ্ট। ’ যদিও সেই চুক্তি এখনো হয়নি, তবে তার মায়ামির গলফ কোর্সে আগামী বছর একটি পিজিএ ট্যুর ইভেন্ট বসবে।

এমএমএ ((মিক্সড মার্শাল আর্টস) ও ইউএফসি (আলটিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপ)–এর বড় ভক্ত ট্রাম্প। এমনকি ২০২৬ সালের ৪ জুলাই, আমেরিকার স্বাধীনতার ২৫০ বছর পূর্তিতে হোয়াইট হাউসের লনে ইউএফসি ইভেন্ট আয়োজনের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন। বিশ্লেষকদের মতে, এটি তার রাজনৈতিক সমর্থকদের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট বার্তা।

ক্রীড়ার ভেতর রাজনীতি টেনে আনা

ট্রাম্পের সমালোচকরা বলছেন, তিনি এখন খেলাধুলাকে সরাসরি রাজনৈতিক এজেন্ডা চাপিয়ে দেওয়ার জায়গা বানাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি চান ওয়াশিংটন কমান্ডার্স আবার ‘রেড স্কিনস’ (লাল চামড়া) নাম ব্যবহার করুক, আর ক্লিভল্যান্ড গার্ডিয়ান্স আবার ‘ইন্ডিয়ানস’ নামে ফিরুক—যা বর্ণবাদী নাম মুছে ফেলার আগের প্রচেষ্টাকে উল্টে দেবে।

একইভাবে তিনি “কিপিং মেন আউট অব উইমেন’স স্পোর্টস” নামে এক নির্বাহী আদেশে সই করেছেন, যাতে ট্রান্সজেন্ডার নারীদের মেয়েদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবার কলেজ ক্রীড়ায় বাণিজ্যিক প্রভাব ঠেকাতে তিনি এনসিএএ–কে ঘিরে ‘সেভিং কলেজ স্পোর্টস’ নামে আরেক আদেশে সই করেছেন।

এছাড়া ইন্ডিয়ানা ফিভারের তারকা কেটলিন ক্লার্ককে ঘিরে বিতর্কে তার সম্পৃক্ততা নিয়েও জল্পনা চলছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প যদি এটিকে রাজনৈতিক বার্তা বানাতে চান, তবে তা ডব্লিউএনবিএ (উইমেন্স ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন)-এর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।

খেলাধুলা–রাজনীতির পুরোনো যোগসূত্র

আসলে খেলাধুলা আর রাজনীতির মিশ্রণ নতুন কিছু নয়। ১৯৪৭ সালে জ্যাকি রবিনসনের বেসবলে অভিষেক ছিল নিছক ক্রীড়া ঘটনা নয়, বরং আমেরিকার বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যেমনটা বলেছিলেন বব কস্টাস, ‘স্টিক টু স্পোর্টস’ মানে হলো, খেলাধুলায় থাকো যতক্ষণ না সেটা আমার মতের সঙ্গে মিলে। ’

আজকের বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রে একজন প্রেসিডেন্ট আছেন যিনি রাজনীতিতে আটকে থাকেন না—বরং খেলাধুলাকেও ব্যবহার করেন নিজের এজেন্ডা এগিয়ে নিতে।

এমএইচএম