স্বর্ণপ্রসবা ডিসিপ্লিন শুটিংয়ের একি হাল!

স্বর্ণপ্রসবা ডিসিপ্লিন শুটিংয়ের একি হাল!

একটা সময় পর্যন্তু শুটিং ছিল বাংলাদেশের স্বর্ণপ্রসবা ডিসিপ্লিন। কমনওয়েলথ গেমস, এসএ গেমসে একাধিকবার বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে শুটিং। এসএ গেমসের কথায় ধরা যাক। ১৯৯১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত শুটিং থেকে এসেছে ৮৯টি পদক। যার মধ্যে সোনার পদক ২১টি। ভারতের অভিনব বিন্দ্রাকে হারিয়ে ২০০২ ম্যানচেস্টার কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জেতেন আসিফ হোসেন খান। কিন্তু সেই বিন্দ্রা পরে জিতেছিলেন অলিম্পিকে সোনা। অথচ আসিফ হারিয়ে গেছেন। অযোগ্য সংগঠকের হাতে পড়ে দেশের স্বর্ণপ্রসবা শুটিং দিনে দিনে বিবর্ণ হচ্ছে। গত এক বছরে তা একেবারে শূন্যের কোঠায় দাঁড়িয়েছে। এশিয়ান শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে তো দলই পাঠাতে পারেনি বাংলাদেশ।
কাজাখস্তানের শিমকেন্টে সদ্য সমাপ্ত এশিয়ান শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে চমক দেখিয়েছে ভারত। ৫০টি স্বর্ণ, ২৬টি রুপা ও ২৩টি ব্রোঞ্জসহ ৯৯টি পদক জিতে ১৭টি দেশের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে নেয়। দু’বছর আগেও দক্ষিণ কোরিয়ার এই টুর্নামেন্টে ১৯টি পদক জিতে তিন নম্বরে ছিল। অথচ সেই এশিয়ান শুটিংয়ে পদকের দেখাই পায়নি লাল সবুজের শুটাররা। আর এবারের আসরে তো অংশই নেয়নি বাংলাদেশ। বৈশ্বিক আসরের মধ্যে কমনওলেথ ও সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসেই পদক রয়েছে বাংলাদেশের। বাকি আসরগুলোতে লাল সবুজের শুটাররা অংশ নেন কেবল অলিম্পিক গেমসের ওয়াইল্ড কার্ডের জন্যই। দেশের ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর মধ্যে সাফল্যের নিড়িখে শুটিংয়েও এগিয়ে ছিল। অথচ আজ সেই শুটিংয়ের কি দুর্দশা। গত এক বছর ধরে কোন প্রতিযোগিতা নেই। শুটাররাও ট্রেনিংয়ের বাইরে। অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলেয়া ফেরদৌসীর মতে, ‘দেশের শুটিং এখন জিরো লেবেলে চলে গেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে অনেক সময় লাগবে।’ যদি তাই হয়, তাহলে জানুয়ারিতে পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় এসএ গেমসে কি হবে? সেই উত্তরও জানা নেই অ্যাডহক কমিটির এই সাধারণ সম্পাদকের। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জানি না কি করতে পারবে ছেলে-মেয়েরা।’ এশিয়ান শুটিংয়ে অংশ না নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কেন এবার অংশই নিতে পারিনি আমরা, তা বিগত কমিটি জবাব দিতে পারবে। কারণ গত ১৫- ১৬ বছর তো উনারাই ছিলেন।’ গত বছর ৫ঠা আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জড়িয়ে পড়েছিল শুটিং ফেডারেশনের নামও। গুঞ্জন ছিল, তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে দমনের উদ্দেশ্যে করা গুলি নাকি শুটিং ফেডারেশনের স্টোর থেকেই নেয়া হয়েছিল। এ জন্য দীর্ঘদিন নাকি ফেডারেশনের স্টোর তালাবদ্ধ ছিল। যেখানে ছিল শুটারদের গুলি, পিস্তল ও রাইফেল। তবে সম্প্রতি সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক স্টোর রুম খুলে ১লা সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে শুটারদের এসএ গেমসের ক্যাম্প। আলেয়া ফেরদৌসী বলেন, ‘১লা সেপ্টেম্বর থেকে ২০ জনকে নিয়ে এসএ গেমসের ক্যাম্প শুরু করেছি’। সাধারণ সম্পাদক আরও অভিযোগ করে বলেন, ‘গত ১৫ বছরে দেশীয় কোনো কোচ তৈরি করা হয়নি। আজ যদি আমাদের পর্যাপ্ত দেশীয় কোচ থাকতো তাহলে একজন বিদেশি কোচ এনে অনুশীলন দিতে পারলেই হতো। তাহলে এত বেগ পেতে হতো না।’ তিনি বলতে থাকেন, ‘দেশের শুটিং ক্লাবগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। তাদের পারফরম্যান্স তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এভাবে আমরা এসএ গেমসে স্বর্ণ আশা করতে পারি না।’ বিদেশি কোচের বিষয়ে নতুন এই সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘শুটিংয়ে ২ জন ইরানি কোচ ছিলেন। একজনকে ৫ই আগস্টের পর বিমানে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আরেকজন চলে গেছেন এমনিতেই। তাছাড়া একজন বিদেশি কোচকে আনতে হলে মাসিক আট থেকে দশ হাজার মার্কিন ডলার প্রয়োজন। অনুশীলন প্রোগ্রাম আর শুটারদের মাসিক খরচাতেই তো আমরা হিমশিম খাচ্ছি। আমাদের আর্থিক সমস্যা রয়েছে। ট্রাস্টের ফান্ডে হাত দিতে পারি না। এইসব সমস্যায় আমরা আছি।’ বাংলাদেশের শুটিং পিছিয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। আগের মহাসচিবের স্বেচ্ছাচারিতার সঙ্গে ছিল না নিয়মিত প্রতিযোগিতা, যে কারণে পাইপলাইনে উঠে আসেনি নতুন শুটার। সার্ভিসেস সংস্থা সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী ও বিকেএসপি নির্ভর হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের শুটিং। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে শুটিংয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্তে উঠে এসেছিল ফেডারেশন আগের মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপুর মহা দুর্নীতি কাণ্ড।
২০১৬ সালে শুটিংয়ের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং সংস্কার কাজের জন্য প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। সে টাকায় ১০টি ডিজিটাল টার্গেট চেঞ্জার স্থাপনের কাজ নেয় মহাসচিবেরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডেলকো বিজনেস এসোসিয়েশন লিমিটেড। যেখানে প্রতিটি টার্গেট চেঞ্জারের মূল্য দেখানো হয় প্রায় ২৬ লাখ টাকা। অথচ একই যন্ত্র পরবর্তী সময়ে ফেডারেশনসহ আর্মি, বিকেএসপি শুটিং ক্লাব আমদানি করে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকায়। এ ছাড়া শুটিং ফেডারেশনের গুদাম থেকে বেশ কিছু অস্ত্র ও গুলি গায়েব হয়ে যাওয়ার অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে। আবার রেজিস্ট্রার খাতায় বেশ কিছু গোলাবারুদ বেশি পাওয়া যায়। শুটিংয়ে এরকম নানা অনিয়মের ঘটনা উঠে এসেছিল ওই তদন্ত প্রতিবেদনে। তবে এসব নিয়ে এই মুহূর্তে কোনো কথা বলতে চান না ফেডারেশনের বর্তমান কর্মকর্তারা। পূর্বের এসবকে একপাশে রেখে শূন্য থেকে শুরু করতে চাইছেন তারা।