নুরুল হাসান সোহান |সংগৃহীত

সব কিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ : নুরুল হাসান সোহান

কাজী নাসিবুল হাসান সান্নু ফুটবলার ছিলেন বটে, কিন্তু জাতীয় দলে খেলার সৌভাগ্য হয়নি। সান্নু খুলনার প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের সেরা গোলরক্ষক ছিলেন। তখন আরামবাগের গোলরক্ষক হিসেবে বেশ নাম-ডাক ছিল সান্নুর।

কিন্তু লাল-সবুজের এই দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ মেলেনি তার। ফলে এই ব্যর্থতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো, ব্যথা দিচ্ছিলো সময়ে সময়ে। কিন্তু বাবার সেই অপূর্ণতা প্রাপ্তির স্রোতে ধুয়ে দিয়েছে ছেলে বহু আগেই।

বাবা যেমন ছিলেন ফুটবলের অতন্দ্র প্রহরী। গ্লাভস হাতে দলকে সুরক্ষা করতেন নিজের সর্বস্ব দিয়ে। দ্রুত গতিতে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে লাফিয়ে উঠে প্রতিহত করতেন বিপক্ষ দলের আক্রমণ।

ছেলেও তাই, গ্লাভস হাতে বাবার মতো ক্ষিপ্ততা তার মাঝেও বহমান। গ্লাভস হাতে দলকে সমর্থন দিতে তার জুড়ি মেলা ভার। দ্রুত সময়ে শরীরের মোচড়ে চুম্বকের মতো হাত সাফাইয়ে কী দারুণ ছবিই না আঁকেন উইকেটের পেছনে।

কখনো কখনো তো বিস্ময়ের বিস্ফোরণও ঘটে যায়। বাবা ছেলের পার্থক্য কেবল দুটো স্থানে। এক, তিনি গোল কিপার, আর ছেলে উইকেট কিপার। আর দ্বিতীয়টা হলো, সান্নু তো ছিলেন খুলনার সেরা, আর ছেলে তার দেশ সেরা!

ছেলের নাম নুরুল হাসান সোহান। বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক আলোচিত নাম। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখনো নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি সোহান। কেন পারেননি, তার অনেক কারণের মাঝে সবচেয়ে বড় কারণ ‘সুযোগ পাননি।’

দেশ সেরা কিপারে তকমা নিয়েও তাকে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছিলো সুযোগের। সময়টা চলছিল তখন মুশফিকুর রহিম আর এনামুল হক বিজয়ের। এরপর এলেন লিটন দাস, মোহাম্মদ মিথুন। অপেক্ষাতেই সময় কাটে সোহানের।

২০১৪ সাল থেকেই আলোচনায় ছিলেন। কিন্তু কেন যেন তবুও সুযোগ মিলছিল না। হয়তো কিপিংয়ে সেরা হলেও, ব্যাট হাতে ততটা সাবলীল ছিলেন না বলে। যাহোক, অবশেষে সুযোগ মেলে জাতীয় দলে, ১৫ জানুয়ারি ২০১৬ সালে।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ৫ বলে ৭ রানে অপরাজিত থাকেন সোহান। পরের ম্যাচে সুযোগ না হলেও, সিরিজের শেষ ম্যাচে ১৭ বলে ৩০ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। তবে এরপর সময়টা ভালো যায়নি, বাদ পড়ে যান দল থেকে।

এরই মাঝে দুটো ওয়ানডে খেলেছিলেন তিনি। ব্যাট হাতে দারুণ করেন সেখানে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাদেরই মাঠে দুই ম্যাচে ২৪ ও ৪৪ রানের ভালো দুটো ইনিংস খেলেন দলের বিপর্যয়ে। কিন্তু তবুও কেন জানি বাদ পড়েন ওয়ানডে দল থেকেও।

এরপর কেবল ফেরার অপেক্ষা। কতো ক্রিকেটার আসে যায়, তবে সোহানের ডাক মেলে না। তবে নিজের সাথে নিজেই লড়াইটা করে গেছেন অবিরত। নিজেকে ভেঙেছেন, নতুন করে গড়েছেন; পুড়ে পুড়ে খাঁটি করেছেন।

‘সফলতার পথ যে মসৃণ নয়, সাহসের সাথে অবিরাম লড়াই এনে দেয় বিজয়।’ শব্দগুলো যেন মনে গেঁথে রেখেছিলেন সোহান। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন, একদিন নিজেকে করবেন প্রমাণ।

কখনো সুযোগ হচ্ছিল না, কখনো সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারছিলেন না, কখনো ভাগ্য সায় দিচ্ছিল না আবার কখনো অন্যের ঘাড়ে চেপেছে অন্যের ব্যর্থতা। দল খারাপ করলে প্রথম কোপটাই যেন পড়তো তার ঘাঁড়ে।

অবশেষে সুযোগ মেলে ৫ বছর পর। ততদিনে বয়সটা ২২ হতে ২৭ ছুঁয়েছে। এইবার ওয়ানডের পাশাপাশি টি-২০ তেও সুযোগ মিলেছে। সুযোগটা না মিললে সোহানের প্রতি একটু বেশীই অবিচার হতো নিঃসন্দেহে।

ঘরোয়া ক্রিকেটে রানবন্যা বইয়ে দিয়ে সুযোগ দিতে বাধ্য করেন সোহান। তবে এবার শুধু দলে সুযোগ নয়, মেলে অধিনায়কত্বও। নিয়মিত অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব পান টি-টোয়েন্টি দলের।

তার নেতৃত্ব জিম্বাবুয়ে ও ওমানের বিপক্ষে তাদের মাটিতে সিরিজ জিতে বাংলাদেশ। ব্যাট হাতে যেখানে দারুণ ভূমিকা রাখেন সোহান। সুযোগ মেলে ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও, সহ-অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পান তিনি।

তবে বিশ্বকাপে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি, ৫ ইনিংসে করেন ৪১ রান। ফলে আবার বাদ পড়েন টি-টোয়েন্টি দল থেকে। কিন্তু ওয়ানডে থেকে বাদ পড়েন বলা যায় কোনো কারণ ছাড়াই।

ছন্দে থাকলেও সুযোগ মেলেনি আর। অথচ শেষ দুই ইনিংসের তার রান ছিল ২৭ বলে ২০ ও ৩৮ বলে ৩২। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে এই দুই ম্যাচে আউট হননি তিনি। সেই যে বাদ গেলেন আর সুযোগ মেলেনি টি-টোয়েন্টি বা ওয়ানডে দলে।

এরপর অবশ্য ২০২৩ সালে টেস্টে সুযোগ মেলে তার। তবে সুবিধা করতে পারেননি। ফলে আবারো বাদ পড়েন দল থেকে, এরপর কেবলই অপেক্ষা। অন্যদিকে সোহানের চেষ্টার পর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

২০২৩ ডিপিএলে মৌসুমেই করেন ৪৯৫ রান। এরপর জাতীয় ক্রিকেট লিগ (এনসিএল) টি-টোয়েন্টির গত আসরে খুলনা বিভাগের হয়ে ব্যাট হাতে আলো ছড়ান। মারকুটে ব্যাটিংয়ে রান পেয়েছিলেন গত ডিপিএলেও।

চলতি বছরের মার্চে হওয়া টুর্নামেন্টে ধানমন্ডি স্পোর্টস ক্লাবের হয়ে ১১ ম্যাচে ২ সেঞ্চুরি ও ২ হাফ সেঞ্চুরিতে ৫১২ রান করেছিলেন সোহান। এ ছাড়া নিউজিল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষেও সেঞ্চুরি করেছিলেন দুটি।

শ্রীলঙ্কা সফরের আগে প্রস্তুতি ম্যাচেও পঞ্চাশ ছোঁয়া ইনিংস খেলেছিলেন। চলমান টপ এন্ড টি-টোয়েন্টি সিরিজেও ব্যাট হাতে রানের দেখা পেয়েছেন ডানহাতি এই উইকেটকিপার ব্যাটার।

এমন ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের জেরেই ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলে ফিরলেন সোহান। অর্থাৎ প্রায় বছর তিনেক পর জাতীয় দলে ফেরা হলো তার।

আজ শুক্রবার (২২ আগস্ট) ছিল এশিয়া কাপের জন্য দল ঘোষণার শেষ দিন। সারাদিন অপেক্ষা করালেও রাতে এসে মহাদেশীয় এই মহারণের জন্য ১৫ সদস্যের দল দিয়েছেন নির্বাচকরা। দলে চমক নেই, বড় খবর নুরুল হাসান সোহানের ফেরা।

বর্তমানে টপ এন্ড টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেলতে অস্ট্রেলিয়াতে অবস্থান করছেন সোহান। দলে ডাক পাওয়ার পর সেখান থেকেই গণমাধ্যমে ছোট করে অনুভূতি জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ।’