পাথর লুটের পর বিবর্ণ হয়ে পড়েছিল প্রকৃতিকন্যা সাদা পাথর। চরম হতাশায় ছিল প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকরা। ব্যবসায় ধস পর্যটনসংশ্লিষ্টদের। এমন হতাশার অন্ধকারে আশার আলো জাগিয়েছে পার্শ্ববর্তী ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দর। শিগগিরই এই স্থলবন্দর পূর্ণতা পাচ্ছে। হয়ে উঠবে অনেকটা আন্তর্জাতিকমানের। থাকছে হাসপাতাল, মসজিদ, রেস্টুরেন্টসহ নানা সুবিধা। এর ব্যয়ভার বহন করছে বিশ্বব্যাংক। শীঘ্রই বিশ্বব্যাংকের টিম সরাসরি স্পট ভিজিটের কথাও রয়েছে। দ্রুত সাজিয়ে তোলা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী সাদা পাথর পর্যটন স্পট। লুট হওয়া পাথর পানি ও মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করে আনছে যৌথ বাহিনী। দ্রুত চলছে প্রতিস্থাপনের কাজ। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলসহ একাধিক সূত্র যুগান্তরকে এমন তথ্য দিয়েছে।
তারা বলছেন, পর্যটনবান্ধব বন্দর হিসাবে গড়ে তোলা হচ্ছে ভোলাগঞ্জকে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন হওয়ার কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে বন্দরের ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। চলছে শেষ মুহূর্তের রং ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ। ২৮ সেপ্টেম্বর অর্থদাতা প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিন অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে। অক্টোবরের শুরুতেই পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসাবে যাত্রা শুরু করবে ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দর।
ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের প্রকল্প পরিচালক সারোয়ার আলম বলেন, এই বন্দর পুরোপুরি পর্যটনবান্ধব করে গড়ে তোলা হচ্ছে। সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রকে ঘিরেই এখানে রেস্টুরেন্ট, গেস্টহাউজ, মসজিদ ও মেডিকেল সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো শুধু বন্দরসংশ্লিষ্ট নয়, স্থানীয় ও পর্যটকরাও ব্যবহার করতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, বন্দর চালু হলে শুধু রাজস্ব বাড়বে না, বদলে যাবে পুরো এলাকার চিত্র।
শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা আব্দুল হালিম জানান, বর্তমানে প্রতিদিন ২৮০ থেকে ৩০০ ট্রাক চুনাপাথর ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ায় আসে, যা সম্পন্ন করতে অনেক সময় লাগে। কিন্তু স্থলবন্দর চালু হলে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টায় একই পরিমাণ ট্রাকের কাস্টমস প্রক্রিয়া শেষ করা যাবে। এতে শুধু সময়ই বাঁচবে না, ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিও বাড়বে। ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক সরাসরি বন্দরে প্রবেশ করে ওয়েট স্কেল ও কাস্টমস সম্পন্ন করে নির্ধারিত পথে বের হবে। এভাবে আলাদা রুট ব্যবহার করায় পর্যটকদের চলাচলে কোনো সমস্যা হবে না। তারা সহজেই বন্দর এলাকা অতিক্রম করে সাদা পাথরের নৌঘাটে পৌঁছাতে পারবেন।
স্থাপনা নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনিক ট্রেডিং করপোরেশনের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, লুটপাটে আমার প্রায় ৬-৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তারপরও আমরা সময়মতো কাজ শেষ করেছি। সহযোগী প্রতিষ্ঠান মাসুদ স্টিলের রাশেদ আহমদ জানান, তারাও নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করতে সক্ষম হয়েছেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দর চালু হলে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, পর্যটনেরও নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। ভোলাগঞ্জ স্টোন ক্রাশার মিল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল জলিল বলেন, বন্দর চালু হলে এলাকার পরিবেশ পালটে যাবে, পর্যটকরা থাকা ও খাওয়ার সুবিধা পাবেন এবং স্থানীয়দের জন্য কর্মসংস্থান বাড়বে।
উল্লেখ্য, ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের যাত্রা শুরু হয় ২০০৫ সালে শুল্কস্টেশন হিসাবে। ভারতীয় খাসিয়া হিলস জেলার মাজাই এলাকা থেকে চুনাপাথর আমদানি শুরু হয় তখন থেকে। ২০১৯ সালে সরকার এটিকে দেশের ২৪তম স্থলবন্দর হিসাবে ঘোষণা করে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বন্দরের উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করেছে অনিক ট্রেডিং করপোরেশন ও মজিদ সন্স অ্যান্ড মাসুদ স্টিল। তবে শুরুতে জমি অধিগ্রহণ ও মাটি ভরাট নিয়ে দীর্ঘ টানাপোড়েন ছিল। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়। এ বছরের ৫ আগস্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সামগ্রী লুটপাটের ঘটনায় কাজ ব্যাহত হলেও দ্রুত আবার শুরু হয় এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করা হয়েছে।
নির্মাণাধীন ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরে বিশাল আধুনিক ক্যাফেটেরিয়া, দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, কাচঘেরা দোতলা পোর্ট ভবন, তিনতলা মাল্টি এজেন্সি ভবন, একটি গেস্টহাউজ, দুটি ডরমিটরি ও একটি ক্লিনিকের কাজ শেষ। প্রতিটি স্থাপনা আলাদা প্রবেশপথে সংযুক্ত। প্রাচীরঘেরা হলেও স্থাপনাগুলো আলাদা জায়গায় করা হয়েছে, যাতে ব্যবহারকারীদের কোনো অসুবিধা না হয়। বন্দরের খালি জায়গায় গাছ লাগানোর প্রস্তুতিও চলছে। পর্যটকদের জন্য রাখা হয়েছে গাড়ি পার্কিং, চিকিৎসা সুবিধা, খাবার ও থাকার ব্যবস্থা। ফলে সাদা পাথরে বেড়াতে আসা মানুষজন সহজেই এসব সুযোগ-সুবিধা পাবেন।