গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে মামলা-বিচারে বাধা নেই: প্রতিযোগিতা কমিশন

গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে মামলা-বিচারে বাধা নেই: প্রতিযোগিতা কমিশন

‘অস্বাভাবিক কম’ দামে সিম বিক্রি করে গ্রামীণফোন অন্যায্যভাবে বাজার দখলের চেষ্টা করছে বলে প্রতিযোগিতা কমিশনে অভিযোগ করেছে মোবাইল অপারেটর কোম্পানি রবি ও বাংলালিংক। এ নিয়ে শুনানি করে কমিশন।

তবে গ্রামীণফোন সেখানে আপত্তি জানায়। গ্রামীণফোনের দাবি, এ নিয়ে প্রতিযোগিতা কমিশন নয়, বিটিআরসি ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার রাখে। এজন্য রবি ও বাংলালিংকের অভিযোগ প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছে গ্রামীণফোন।

এদিকে, শুনানি শেষে সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রায় ঘোষণা করেছে প্রতিযোগিতা কমিশন। এতে গ্রামীণফোনের অভিযোগ প্রত্যাহারের আবেদন নাকচ করে দিয়েছে কমিশন। ঘোষিত রায়ে বলা হয়েছে, গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে মামলা ও বিচারকাজ চালাতে কমিশনের কোনো আইনগত বাধা নেই।

জানা যায়, গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বোরাক টাওয়ারে অবস্থিত প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যালয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। তাতে অংশ নেন গ্রামীণফোন ও রবির কর্মকর্তা এবং আইনজীবীরা। কমিশন চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসানের নেতৃত্বে দুই পক্ষের যুক্তি শোনেন তিনজন সদস্য। তারা হলেন ড. আক্তারুজ্জামান তালুকদার, ওয়াহিদ হাসান শাহ ও আফরোজা বিলকিস। সেদিন শুনানির পর সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়।

রায়ে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, প্রতিযোগিতা লঙ্ঘন করার বিষয় প্রতিযোগিতা কমিশনই গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখবে। তদন্ত অনুযায়ী মামলা ও বিচারকাজ চালিয়ে যেতে কমিশনের আইনগত কোনো বাধা নেই।

আরও পড়ুন
অনুমতি ছাড়া গান ব্যবহারে গ্রামীণফোনকে নোটিশ, দাবি ২০ কোটি

এ এইচ এম আহসান বলেন, এটা বিটিআরসির বিষয়ও নয়। বিটিআরসি রেগুলেটরের (নিয়ন্ত্রক) ভূমিকা পালন করবে। আর প্রতিযোগিতা কমিশন বাজারে নেতিবাচক প্রভাব দূর করতে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।

এদিকে, প্রতিযোগিতা কমিশনের এমন রায়ের পর ‘প্রভাবশালী অপারেটর’ হওয়ায় ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করে গ্রামীণফোন বাজারে অস্বাভাবিক কম দামে বিক্রি করে বাজার দখলের চেষ্টার যে অভিযোগ রবি ও বাংলালিংক করেছে, তা তদন্ত করতে আর বাধা নেই। ফলে খুব শিগগির এ তদন্তকাজ শুরু করবে প্রতিযোগিতা কমিশন। এজন্য শিগগির পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হবে। সেদিন সেখানে বাংলালিংকের প্রতিনিধিও উপস্থিত থাকবেন।

কমিশনের রায়ে রবি সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছেন অপারেটরটির পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার সামির সত্তার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিযোগিতা কমিশন যুক্তি-তর্ক ও আইনি ধারায় অকাট্য প্রমাণ পাওয়ায় রবির পক্ষে রায় দিয়েছেন। রায়ে বলা হয়েছে, বাজারের নেতিবাচক বিষয় দেখার এখতিয়ার বিটিআরসির নয়। এটি প্রতিযোগিতা কমিশনই করবে। এজন্য গ্রামীণফোন যে আবেদনটি করেছিল, তা রায়ে বাতিল করে দিয়েছে কমিশন।

রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, বাজারে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হবে। উদ্ভাবন ও ন্যায্য প্রতিযোগিতা গ্রাহকদের এবং সামগ্রিকভাবে শিল্পের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। প্রতিযোগিতা কমিশনকে আমরা পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

প্রতিযোগিতা কমিশনের রায়ের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে গ্রামীণফোন। এক বার্তায় অপারেটটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘আমরা জানতে পেরেছি যে, একটি আদেশ জারি হয়েছে। তবে আমরা এখনো আদেশের কোনো প্রত্যয়িত অনুলিপি পাইনি। তাই এ বিষয়ে এখনই বিস্তারিত মন্তব্য করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’

গ্রামীণফোন বলেছে, ‘তবুও আমরা দৃঢ়ভাবে আবারও বলতে চাই, গ্রামীণফোন বাংলাদেশের প্রচলিত প্রতিযোগিতা আইন মেনে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। গ্রামীণফোন কোনোভাবেই প্রতিযোগিতাবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত নয়। মূল্য নির্ধারণ, বিপণন ও বিতরণ সম্পর্কিত সব অভিযোগ আমরা সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করি।’

‘দেশের টেলিযোগাযোগ খাতটি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) কর্তৃক কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। ২০০১ সালের বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী পরিচালিত এ খাত ন্যায্য প্রতিযোগিতা, উন্মুক্ত বাজার এবং গ্রাহকের অধিকার নিশ্চিত করে। বিটিআরসি একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাজারে প্রবেশ, মূল্য নির্ধারণ এবং সব প্রতিযোগিতামূলক কার্যক্রমের তদারকি করে থাকে। গ্রামীণফোন বর্তমানে একটি এসএমপি অপারেটর হিসেবে আইনানুগভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।’

গ্রামীণফোন আরও বলেছে, ‘আমরা অসম এমএনপি লক-ইন, ক্যাম্পেইন অনুমোদন, ইন্টারকানেকশন চার্জসহ আরও কিছু কঠোর নিয়ন্ত্রক নির্দেশনার সুনির্দিষ্ট ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছি। এমন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন ও নেতিবাচক প্রতিযোগিতামূলক উদ্দেশ্যের প্রতিফলন।’

প্রতিযোগিতা কমিশনে জমা পড়া অভিযোগ অনুযায়ী, গত বছর সরকার প্রতিটি সিমে ৩০০ টাকা কর ধার্য করলেও অপারেটররা বাজার দখলের জন্য ভর্তুকি দিচ্ছে। রবি প্রতিটি সিম ১৯৯ টাকায় বিক্রি করেছে, যেখানে গ্রামীণফোন বিক্রি করেছে ১৬৯ টাকায়। একই সঙ্গে গ্রামীণফোন বিক্রেতাদের ১২২ টাকা কমিশন দিয়েছে, যা রবির দেওয়া সর্বোচ্চ ৮৯ টাকার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে কমিশন বাদ দিলে গ্রামীণফোনের সিমের প্রকৃত মূল্য দাঁড়ায় মাত্র ৪৭ টাকা, যা রবির তুলনায় ৫৭ শতাংশ কম।

বর্তমানে দেশের মোবাইল ফোন বাজারে চারটি অপারেটর সেবা দিচ্ছে, যার মধ্যে মোট ১৮ কোটি ৮৪ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৮ কোটি ৬৫ লাখই গ্রামীণফোনের। গ্রামীণফোন কেবল গ্রাহক সংখ্যায় নয়, বরং প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার বাজারের অর্ধেকও নিজেদের দখলে রেখেছে। এ কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) গ্রামীণফোনকে ‌‘বাজারের আধিপত্যকারী’ বা ‘এসএমপি’ (সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার) অপারেটর হিসেবে ঘোষণা করে এবং কলরেট বৃদ্ধিসহ বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে।