নলিউড: বছরে আড়াই হাজার সিনেমা মুক্তি পায় যে ইন্ডাস্ট্রিতে
এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সপ্তাহে গড়ে ৫০টি সিনেমার শুটিং হয়। বছরে নির্মিত হয় ২ হাজার ৫০০ সিনেমা। সিনেমার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ১০ লাখ কর্মী। বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায়—নাম নলিউড।
নাইজেরিয়াতে প্রথম সিনেমা প্রদর্শিত হয় ১৯০৩ সালে। তবে নাইজেরিয়াকে সিনেমা বানাতে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও ২৩ বছর। ‘পালাভার’ নামে সেই সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন জিওফ্রে বারকাস। সিনেমায় নাইজেরিয়ান অভিনয়শিল্পীরা নাম লেখান। নাইজেরিয়া তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ, সিনেমা-সংশ্লিষ্ট অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন বিদেশি। কিছু প্রতিষ্ঠানের অংশীদার ছিলেন নাইজেরিয়ান। তবে তাঁরা নির্মাণে পারদর্শী ছিলেন না। নাইজেরিয়ান তরুণেরা থেমেও থাকেনি।
পঞ্চাশের দশক থেকে নিজস্ব প্রযোজনায় সিনেমা নির্মিত হতে থাকে। ১৯৫৭ সালে দেশটি রঙিন সিনেমার যুগে প্রবেশ করে। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণে নানা রকম বাধা থাকায় সব রকম গল্প বলা যেত না। ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই ডালপালা মেলতে শুরু করে নলিউড। একের পর এক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বিদেশিদের প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানাও নিয়ে নেন নাইজেরীয়রা। বাড়তে থাকে হল। সত্তরের দশক থেকেই অর্থনীতিতে অবদান রাখা শুরু করে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি। দেশটির সরকারও তখন থেকে সিনেমাশিল্পে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিতে থাকে।
নলিউডের স্বর্ণযুগ
১৯৭০–এর পর ধীরগতিতে হাঁটলেও নব্বইয়ের দশক থেকে মাথাচাড়া দিতে থাকে এই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি। ৩৫ মিলিমিটার ফিল্ম দিয়ে শুটিং ব্যয়বহুল। তাই ভিএইচএস টেপ দিয়েই শুরু হয় সিনেমা বানানো। তাইওয়ানের ভিএইচএস টেপ ভিডিও দিয়ে বিশ্বজুড়েই তখন বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠানের ভিডিও করা হতো। রেজল্যুশন ছিল খুবই কম। টিভিতে দেখার উপযোগী। যে কারণে এসব টেপ দিয়ে সচরাচর সিনেমার কাজ কেউ করত না। এগুলোকে বলা হতো হোম ভিডিও। এই ভিএইচএস টেপ দিয়েই তৈরি হয় ‘লিভিং ইন বন্ডেজ’।
১৯৯২ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটি তুমুল ব্যবসা করে। দর্শকদের কাছে গল্প ভালো লাগায় ভিজ্যুয়াল তেমন গুরুত্ব পায়নি। সফল এই পদ্ধতিতে কম খরচে একের পর সিনেমা নির্মিত হতে থাকে। স্থানীয় দর্শকদের কথা মাথায় রেখে খুবই কম বাজেটে সে সময় সিনেমা নির্মাণ করতেন তাঁরা।
যেভাবে তৃতীয়
২০০০ সালের পর থেকে দ্য সিলভারবার্ড গ্রুপ, জেনেসিস ডিলাক্স সিনেমাসসহ একাধিক বড় প্রোডাকশন হাউস আধুনিক সিনেমা নির্মাণে মনোযোগ দেয়। শুরু হয় নিউ নাইজেরিয়ান সিনেমার যুগ। এই যুগের উল্লেখযোগ্য একটি সিনেমা ‘ইরাপাডা’। একই সঙ্গে সিনেমায় বিনিয়োগের জন্য ২০০৬ সালে ইকো ব্যাংকের সঙ্গে সরকার যৌথভাবে প্রজেক্ট নলিউড চালু করে। তারা উচ্চ মানের সিনেমা নির্মাণে ১০০ মিলিয়ন মাইরা (নাইজেরিয়ার মুদ্রা) বিনিয়োগ করে। সেই সময়ের মুদ্রামানে যা ছিল প্রায় ৮ লাখ ডলার। সিনেমা নির্মাণের পাশাপাশি এই অনুদান নির্মাতাদের প্রশিক্ষণ, ইন্ডাস্ট্রির অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। সিনেমার কারিগরি ও নির্মাণ মান ভালো হতে থাকে। এতে ভালো ফলও পাওয়া যায়।
২০০৯ সালে ‘দ্য ফিগারিন’ দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃষ্টি কাড়ে নলিউড। সিনেমাটি সে বছর আয়ে রেকর্ড গড়ে। পরে ‘দ্য ওয়েডিং পার্টি’ এই রেকর্ড ভেঙে চার বছর আয়ে শীর্ষ রেকর্ড ধরে রেখেছিল। নিউ নাইজেরিয়ান সিনেমার সফলতা দেখে ২০১৩ সালে ২০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয় সরকার। একের পর এক প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে ফিল্ম স্কুল ও অন্যান্য উন্নত অবকাঠামো। সিনেমায় বিপুল লগ্নি দেখে প্রযোজকদের ঋণ দিতে এগিয়ে আসে বেশ কিছু ব্যাংক।
ফল, ২০১৩ সালেই আয়ে আগের রেকর্ড ভাঙে নলিউড। প্রথমবারের মতো আয় দাঁড়ায় ১১ বিলিয়ন ডলার। পরের বছর নলিউড আয় করে ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। জিডিপিতে অবদান ১ দশমিক ৪ শতাংশ। মান ভালো না থাকায় যে ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে নাক সিটকাত লোকজন, অচিরেই আয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ইন্ডাস্ট্রি হয়ে ওঠে সেই নলিউড। তাঁদের সামনে আছে শুধু হলিউড আর বলিউড। পেছনে চীন ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি।
ফল, ২০১৩ সালেই আয়ে আগের রেকর্ড ভাঙে নলিউড। প্রথমবারের মতো আয় দাঁড়ায় ১১ বিলিয়ন ডলার। পরের বছর নলিউড আয় করে ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। জিডিপিতে অবদান ১ দশমিক ৪ শতাংশ। মান ভালো না থাকায় যে ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে নাক সিটকাত লোকজন, অচিরেই আয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ইন্ডাস্ট্রি হয়ে ওঠে সেই নলিউড। তাঁদের সামনে আছে শুধু হলিউড আর বলিউড। পেছনে চীন ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি।
কেন দেখেন দর্শক
নলিউড সিনেমার গল্পে গুরুত্ব পায় নাইজেরিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চলের মানুষের কথা। তাদের টার্গেট গ্রুপ এই অঞ্চল। এই অঞ্চলের মানুষের পারিবারিক কাঠামো, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক নানা ঘটনা প্রায় এক; এটাই তাদের বিশ্বাস। যে কারণে তাদের দর্শকসংখ্যা বড়। তা ছাড়া নলিউড সিনেমার উপস্থাপনেও থাকে নিজস্ব ঢং। দেশীয় সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেয় তারা। নিজেদের গল্প, নির্মাণশৈলী, অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে তারা সব সময়ই চ্যালেঞ্জ নিয়ে থাকে।
নলিউডের বিখ্যাত প্রযোজক জোকে সিভলা এক সাক্ষাৎকার বলেন, ‘নলিউড সিনেমা নাইজেরিয়ান সমাজের দর্পণ। এখানে গৎবাঁধা কোনো গল্পের মধ্যে আটকে থাকার চেষ্টা কেউ করে না। আফ্রিকান জীবনের বাস্তবচিত্রই পর্দায় উঠে আসে।’
নলিউডেও আছে শাখা
বলিউডের মতো নলিউডেও ভাষাগত দিক থেকে রয়েছে বৈচিত্র্য। প্রধানত তিনটি সাব ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে নলিউড। এর মধ্যে আলোচনায় বেশি থাকে ইউরুউড। এখানে ইয়োরুবা ভাষায় সিনেমা নির্মিত হয়। ক্যানিউড ইন্ডাস্ট্রিতে হাউসা ভাষায় সিনেমা নির্মিত হয়। তিন নম্বর হিসেবে আলোচনায় রয়েছে ইগবোউড ইন্ডাস্ট্রি। এখানে ইগবো ভাষায় সিনেমা নির্মিত হয়। এসব ইন্ডাস্ট্রির সিনেমাগুলোর স্টাইলও আলাদা। তারা সবাই নাইজেরিয়ার সিনেমাটিক ল্যান্ডস্কেপে গল্প বলে।
তবে ক্যানিউড ইন্ডাস্ট্রিতে ইসলামের ভিত্তিকে সামনে রেখে সিনেমা বানানো হয়। ইগবোউড ইন্ডাস্ট্রির সিনেমায় উঠে আসে ইগবুদের ঐতিহ্যগত থিম ও সামাজিক ইস্যু। এসব সিনেমার বেশির ভাগের বাজেট ৭ হাজার থেকে ১৩ হাজার ডলার। সচরাচর দুই সপ্তাহের মধ্যেই একটি সিনেমার সব কাজ শেষ হয়। তবে বড় বাজেটের সিনেমার ক্ষেত্রে সময় কিছুটা বেশি লাগে। সেগুলোর বাজেট ৫০ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। সেটা সংখ্যায় কম।
এসব সিনেমার বেশির ভাগের বাজেট ৭ হাজার থেকে ১৩ হাজার ডলার। সচরাচর দুই সপ্তাহের মধ্যেই একটি সিনেমার সব কাজ শেষ হয়। তবে বড় বাজেটের সিনেমার ক্ষেত্রে সময় কিছুটা বেশি লাগে। সেগুলোর বাজেট ৫০ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। সেটা সংখ্যায় কম।
কানে প্রথমবার
হাজার হাজার সিনেমা নির্মিত হলেও সম্মানজনক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে অফিশিয়াল মনোনয়ন ও পুরস্কারে পিছিয়ে ছিল নলিউড। অবশেষে এ বছর প্রথমবারের মতো কানের অফিশিয়াল শাখা আঁ সার্তে রিগায় মনোনয়ন পায় নাইজেরিয়ার সিনেমা ‘মাই ফাদারস শ্যাডো।’ ১৯৯৩ সালে অস্থির ছিল নাইজেরিয়ার লাগোসসহ বেশ কিছু শহর। রাজনৈতিক সেই অবস্থায় একটি পরিবারের একত্র হওয়ার গল্প এতে তুলে ধরা হয়েছে। এটি পরিচালনা করেছেন আকিনোলা ডেভিস। এটা তাঁর প্রথম সিনেমা। সিনেমাটি এ বছর কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে স্পেশাল ম্যানশন হিসেবে গোল্ডেন ক্যামেরা স্বীকৃতি পায়। সানড্যান্সসহ বিশ্বের নানা উৎসব থেকে পুরস্কার পাচ্ছে এখন নলিউড সিনেমা। নির্মিত হচ্ছে আর্ট হাউসসহ বিভিন্ন ঘরানার সিনেমা। সেসব সিনেমা নিয়মিত নেটফ্লিক্স, ডিজনি প্লাসসহ নানা ওটিটিতে মুক্তি পাচ্ছে।
অ্যানিমেশন সিনেমার দিকেও নজর দিচ্ছে নলিউড। শুধু তা–ই নয়, তথ্যপ্রযুক্তিতেও এখন এগিয়ে যাচ্ছে নলিউডের তরুণেরা। তাঁরা বুঝে ফেলেছেন যে পরবর্তী সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে প্রযুক্তির ওপর। নাইজেরিয়ার সরকারও সচেতন। সিনেমার সঙ্গে যুক্ত ২০ হাজার তরুণকে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার কৌশলগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে তারা। এটা টানা অব্যাহত থাকবে। এর মধ্যেই গত সপ্তাহে এআই সিনেমা যুগে প্রবেশ করেছে নলিউড। তাদের প্রথম এআই সিনেমা ‘মাকেম্যাশন’।
অর্থনীতিতে অবদান
পপকর্ন, কোমল পানীয়সহ নাইজেরিয়ায় সিনেমার টিকিটের মূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য টিকিটের মূল্য ২০০ টাকা। এই হিসাব শুধু নলিউড সিনেমার জন্য প্রযোজ্য, হলিউড বা বলিউড সিনেমার জন্য দর্শকদের আরও বেশি খরচ করতে হয়। ২৭ কোটি জনসংখ্যার দেশটির নিয়মিত সিনেমার দর্শক দেড় কোটি। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের আরও ৫০ লাখ দর্শক নিয়মিত নলিউড সিনেমা দেখেন। ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, নাইজেরিয়ার জিডিপিতে ২ দশমিক ৩ ভাগ অবদান রাখে সিনেমা। বছরে ৬৬০ মিলিয়ন ডলার। সিনেমার সঙ্গে যুক্ত শ্রমশক্তি হিসাব করলে সেটা বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। দেশটি প্রধানত তেল রপ্তানি করে। বেশ কয়েকবার তেল রপ্তানিতে ধস নামলেও আয়রোজগারে সরকারকে সব সময় খুশি রেখেছে সিনেমা। তবে গত কয়েক বছরের তুলনায় এই বছর তাদের সিনেমার আয় কমেছে। সরকারি পর্যায় থেকে এবার সবচেয়ে বেশি সহায়তা করা হচ্ছে। এ বছর নাইজেরিয়া সরকারের টার্গেট নলিউডের আয় ১৪ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়া। সে লক্ষ্যেই কাজ করছে তারা।
নলিউডের শীর্ষ ১০ সিনেমা
১. ‘এভরিবডি লাভস জেনিফা’ (২০২৪), আয় ১২ লাখ ডলার
২. ‘আ ট্রাইব কলড জুধা’ (২০২৩), আয় ১০ লাখ ডলার
৩. ‘ব্যাটল অন বুকা স্ট্রিট’ (২০২২), আয় ৪ লাখ ৩২ হাজার ডলার
৪. ‘ওমো ঘেটো: দ্য সাগা’ (২০২০), আয় ৪ লাখ ১১ হাজার ডলার
৫. ‘আলাকাদা: ব্যাড অ্যান্ড বউজি’ (২০২৪), আয় ৩ লাখ ২২ হাজার ডলার
৬. ‘দ্য ওয়েডিং পার্টি’ (২০১৬), আয় ৩ লাখ ডলার
৭. ‘দ্য ওয়েডিং পার্টি ২’ (২০১৭), আয় ২ লাখ ৮০ হাজার ডলার
৮. ‘ওরি রিবার্থ’ (২০২৫) আয় ২ লাখ ৫৮ হাজার ডলার
৯. ‘চিফ ড্যাডি’ (২০১৮), আয় ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার
১০. ‘কুইন লতিফা’ (২০২৪), আয় ২ লাখ ৩৬ হাজার ডলার
তথ্যসূত্র: বিবিসি, সিএনএন, ফোর্বস আফ্রিকা, ফিন্যানশিয়াল টাইমস, বিজনেস নিউজ নাইজেরিয়া, ফ্রান্স২৪ডটকম ও উইকিপিডিয়া