Advertisement

চাকরি ছাড়ছেন যুক্তরাষ্ট্রের সফল নারীরা, পেছনের কী কারণ

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট, ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের পতাকাছবি: এএফপি
যুক্তরাষ্ট্রের পতাকাছবি: এএফপি

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে ২ লাখ ১২ হাজার নারী কর্মক্ষেত্র ছেড়েছেন, একই সময়ে কর্মজগতে প্রবেশ করেছেন ৪৪ হাজার পুরুষ। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের চাকরির পরিসংখ্যানে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

অর্থনৈতিক তথ্যের মতো এ ক্ষেত্রেও একাধিক কারণ থাকতে পারে, কেন নারীরা চাকরি ছাড়ছেন আর পুরুষেরা নিয়োগ পাচ্ছেন। বিষয়টা চোখে পড়ার মতো। কেননা, উচ্চপদস্থ ও ভালো চাকরি করা নারীরা জানাচ্ছেন, ক্যারিয়ার সম্পর্ক তাঁরা নতুন করে ভাবছেন।

নিউইয়র্ক টাইমসে লেখা এক নিবন্ধে লেখক ইসি লাপোভস্কি এই প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, অনেকে এই প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছেন ‘পাওয়ার পজ’ বা ক্ষমতায়নের পথে বিরতি দেওয়া। বহু বছর ধরে নিরন্তর পরিশ্রম করে ক্যারিয়ার উন্নয়নে এতটা পথ এগোনোর পর এখন কলেজশিক্ষিত নারীদের একাংশ খণ্ডকালীন চাকরিতে যাচ্ছেন, কিংবা একেবারেই চাকরি ছাড়ছেন।

চাকরি না করা যে সবার পক্ষে অর্থনৈতিকভাবে সম্ভব নয়, তা স্পষ্ট। তাই এ প্রবণতা কতটা গভীর, তা বোঝার জন্য আরও তথ্য প্রয়োজন। গত কয়েক বছরে হওয়া বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, কোভিড-১৯-এর পর থেকে চাকরি ছাড়ার কথা ভাবছেন কিংবা কাজের সময় কমানোর কথা ভাবছেন, এমন নারীর সংখ্যা বাড়ছে।

এই নারীরা প্রকৃত পক্ষে কী কারণে চাকরি ছাড়ছেন এবং নারীদের ক্যারিয়ার উন্নয়নে তার কী প্রভাব হতে পারে, সেই বিষয় নিয়ে লেখক আইসির সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি।

আইসি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এক শ্রেণির সফল নারী সম্প্রতি কর্মক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। তাঁরা বাধ্য হয়ে নন, বরং সচেতন সিদ্ধান্তে এই পথ বেছে নিচ্ছেন। নতুনভাবে নিজেদের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করছেন। কেউ সন্তানকে সময় দিতে চেয়েছেন, কেউ উদ্যোক্তা হতে চেয়েছেন, আবার কেউ সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবনধারায় যেতে চেয়েছেন।

লেখক ও সাংবাদিক ইসি লাপোভস্কি এই ঘটনাকে বলেন ‘দ্য পাওয়ার পজ’ বা ক্ষমতায়নের পথে বিরতি। তাঁর ভাষায়, এই নারীরা প্রচলিত ধারণার বিপরীতে দাঁড়াচ্ছেন। সাধারণত মনে করা হয় নারীরা বাধ্য হয়ে যখন কর্মক্ষেত্র ছাড়েন, কিন্তু এখানে তা নয়, তাঁরা সচেতনভাবে নিজেদের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

ইসি লাপোভস্কি আরও বলেন, এর বাইরেও অসংখ্য নারী আছেন, যাঁরা মূলত বিকল্প বা ভিন্ন পথ না পেয়ে চাকরি ছাড়েন, যেমন শিশুর দেখাশোনার খরচ বহন করতে না পারা বা ছাঁটাইয়ের শিকার হওয়া।

এই প্রবণতা দেখে অনেকে বলছেন, ইতিহাসের যেন পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। ব্রিটিশ সাংবাদিক ক্যাটি কে লাপোভস্কিকে প্রশ্ন করেন, ‘২০০৮ সালে আমি প্রথম ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে নারীদের নিয়ে গবেষণা শুরু করি। তখন প্রথমবার দেখি, কিছু ক্ষেত্রে যত নারী কর্মজগতে প্রবেশ করছেন, তার চেয়ে বেশি নারী চাকরি ছাড়ছেন। আপনার লেখাটি পড়ে মনে হলো আবারও কি আমরা একই জায়গায় ফিরে গেলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কি আজও সেই পথ খুঁজে পেলাম না, যেখানে নারীরা পেশাগত জীবন ও মাতৃত্বের মধ্যে তৃপ্তিদায়ক সমন্বয় আনতে পারেন। আমি কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্যের তত্ত্ব পছন্দ করেন না।

■ গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ২ লাখ ১২ হাজার নারী কাজ ছাড়েন। ■ একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪ হাজার পুরুষ কর্মজগতে প্রবেশ করেছেন।

লাপোভস্কির উত্তর ছিল স্পষ্ট, বিষয়টি শুধু না পারার মধ্যে নয়। তিনি বলেন, অনেক নারী বলছেন, তাঁরা চাইলে সামলাতে পারতেন। একজন নারী তাঁকে বলেন, ‘যদি সবকিছু পাওয়া বলে কিছু থাকে, আমি তা পেয়েছি।’ আরেকজন বলেন, তাঁর ন্যানি রাখার সামর্থ্য ছিল, কিন্তু তাঁর উত্তর ছিল, ‘আমি আরেকজন ন্যানি চাই না, আমি আমার সময় চাই।’

অর্থাৎ এখানে আর্থিক সীমাবদ্ধতা নয়, বরং ব্যক্তিগত অগ্রাধিকারই মুখ্য হয়ে উঠছে। অনেকে আবার মা নন, অন্য জীবনধারা বেছে নেওয়ার জন্যই চাকরি ছাড়ছেন।

লাপোভস্কি বিশেষভাবে দেখিয়েছেন, মহামারি এই প্রবণতায় বড় ভূমিকা রেখেছে। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, মহামারির শুরুতে তিনি নতুন মা। তিনি ও তাঁর স্বামী দুজনই পূর্ণকালীন চাকরি করতেন, শিশুর সেবাযত্নের ব্যবস্থা ছিল না। তখন ভাবতাম, ‘আমার সন্তান পাশের ঘরে, এটা আমার ভালো লেগে যাচ্ছে। আগে কখনো ভাবিনি কাজ থেকে সরে দাঁড়াব, কিন্তু হঠাৎ মনে হলো, এটা করা সম্ভব।’

লাপোভস্কির প্রশ্ন, লাখ লাখ নারী সম্পর্কে যেভাবে বলা হচ্ছিল, তাঁরা ‘বাধ্য হয়ে’ চাকরি ছাড়ছেন, তার মধ্যে প্রকৃত অর্থে কতজন সচেতন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তথ্যেও সেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। মহামারির পর গৃহিণী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেওয়া নারীর সংখ্যা বেড়েছে। অনেকেই বলেছেন, তাঁরা সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে চেয়েছেন, শিশুর দেখাশোনার খরচ বহন করতে না পারার কারণে নয়। খণ্ডকালীন বা ঘরে বসে কাজ করা নারীর সংখ্যাও বেড়েছে। আবার ম্যাককিন্সি ও লিনইনের গবেষণা বলছে, নেতৃত্বস্থানীয় নারী-মা ও মা নন, এমন উভয়েই রেকর্ড সংখ্যায় চাকরি ছেড়েছেন।

তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। লাপোভস্কির মতে, সব নারীই ভেতরে ভেতরে সংগ্রাম করেছেন, বিশেষ করে অশ্বেতাঙ্গ নারীদের জন্য বিষয়টি আরও কঠিন। তাঁরা ভেবেছেন, বৃহত্তর লড়াইয়ের জন্য কতটা সুখ-শান্তি বিসর্জন দেবেন, যেখানে এত বছর ধরে এত কষ্ট করছেন; নিজের শ্রমের ফসল তিনি কতটা উপভোগ করতে পারবেন।

অনেকে ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত হয়েছেন। কেউ বলেছেন, তিনি হয়তো কয়েক বছর এভাবে থাকতে চান, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তাঁর ক্যারিয়ারের কী হবে।

এ কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নতুন ধারা দেখা যাচ্ছে। বিশেষত লিংকডইনে নারীরা প্রকাশ্যে লেখেন, ‘আমি সচেতনভাবে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।’ তাঁরা এটিকে ‘চাকরি না করা’ হিসেবে নয়, বরং একধরনের জীবনযাত্রা হিসেবে উপস্থাপন করছেন।

সবশেষে লাপোভস্কির সারসংক্ষেপ, এসব সিদ্ধান্ত আসছে আশাবাদ থেকে। নারীরা ক্ষমতায়িত বোধ করছেন। তবে একই সঙ্গে অসংখ্য নারী আছেন, যাঁদের হাতে বিকল্প নেই, ফলে ভবিষ্যৎ মিশ্র। একদিকে শিক্ষিত ও সচ্ছল নারীদের জন্য চাকরি না করা ক্ষমতায়নের এক মাত্রা, অন্যদিকে অনেক নারীর জন্য চাকরি করা বাধ্যতামূলক বাস্তবতা।

Lading . . .