Advertisement

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফাঁক গলেই রাশিয়ার বাণিজ্য, থামেনি যুদ্ধ

প্রথম আলো

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট, ২০২৫

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকাছবি: রয়টার্স
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকাছবি: রয়টার্স

অন্য কোনো দেশকে তাদের ‘অপরাধের’ জন্য শাস্তি দিতে কোন ধরনের ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র—পারমাণবিক অস্ত্রের যুগে সেই উত্তর হলো—অর্থনৈতিক শক্তি। অর্থাৎ কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং মার্কিন ডলারের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দিলে যে চরম অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হবে, তা কোনো দুষ্ট রাষ্ট্রকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করবে।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞার শিকার দেশ রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের চাওয়া পূরণে তেমন কোনো তাড়া অনুভব করছে না। অর্থাৎ ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে রাজি নয় তারা।

২০২২ সালের পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছয় হাজারের বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এসব কার্যকর করতে হলে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোকে সব লেনদেন খতিয়ে দেখতে হয়, অবৈধ কার্যকলাপ ঠেকাতে হয়। ব্যর্থ হলে তারা নিজেরাই মার্কিন জরিমানা কিংবা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারে।

তবু রাশিয়া হাজার হাজার কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। এর এক কারণ হতে পারে যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এসব লেনদেনের প্রক্রিয়া চলমান রেখেছে, তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না।

নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণ বলছে, ২০১৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের জন্য সবচেয়ে বড় যে ১০টি জরিমানা আরোপ করা হয়েছে, তার ৮টিই ছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর। এর মধ্যে রাশিয়া–সংক্রান্ত কেবল দুটি ঘটনা—একটি রুশ ধনকুবেরের ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সংস্থার বিরুদ্ধে, আরেকটি ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ বাইন্যান্সের বিরুদ্ধে। তবে বাইন্যান্স মূলত রাশিয়ার কারণে নয়; বরং ইরান, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া ও কিউবার মতো দেশগুলোকে লেনদেনের সুযোগ করে দেওয়ার কারণে জরিমানা খেয়েছিল।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা ৬ হাজার প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই ব্যক্তি ও ছোট শেল কোম্পানি; রাশিয়ার বাইরে অবস্থিত বড় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩০টির কম, এর মধ্যে কেবল ৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

যুদ্ধ দীর্ঘায়ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়া পশ্চিমা দুনিয়া থেকে বিচ্যুত হয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। সে কারণেই রাশিয়াকে সহযোগিতা করা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রও জটিলতার মুখে পড়েছে।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও সাবেক মার্কিন ট্রেজারি কর্মকর্তা এডওয়ার্ড ফিশম্যান বলেন, পৃথিবীতে অনেক প্রতিষ্ঠানই পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞার হুমকি লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেউ কি প্রকৃত অর্থেই সংযুক্ত আরব আমিরাত বা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে চান।

চীনের বড় ব্যাংকগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কার্যত থমকে যেতে পারে। মার্কিন কোম্পানিগুলো চীনা কারখানাগুলোকে অর্থ দিতে পারবে না, নিজেদের রপ্তানির অর্থও পাবে না। ইলেকট্রনিকস থেকে শুরু করে ওষুধ—সবকিছুর সরবরাহব্যবস্থা আটকে গিয়ে দাম বাড়িয়ে দেবে। সে জন্যই অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, চীনের বড় ব্যাংকগুলোকে কার্যত স্পর্শ করা সম্ভব নয়।

একসময় নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা মানেই ছিল আর্থিক মৃত্যুদণ্ড। ডলারের বৈশ্বিক প্রভাবের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করতে না পারা মানেই ছিল বিশ্ব অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে যে তিন হাজার পৃষ্ঠার নিষেধাজ্ঞার তালিকা ঝুলছে, তার সূত্রপাত সেই ১৯৬০–এর দশকে।

শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করা নিষিদ্ধ নয়, ডলার ব্যবহারকারী কোনো ব্যাংকের সঙ্গেও লেনদেন করতে পারে না এসব প্রতিষ্ঠান। মার্কিন ডলার আন্তর্জাতিক লেনদেনে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত মুদ্রা হওয়ায় এই নিষেধাজ্ঞা কার্যত তাদের বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিত।

২০ বছর আগে ‘অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল’ মূলত ছোটখাটো নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গকারীদের সামলাত। যেমন কিউবান সিগার পাচারের মতো অপরাধের জন্য গড়ে কয়েক হাজার ডলার জরিমানা দিত, সরকারি নথির বিশ্লেষণ বলছে। কিন্তু পরবর্তীকালে সাধারণ হাতিয়ার থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কর্মসূচি একেবারে পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রীয় অস্ত্রে পরিণত হয়।

২০০০–এর দশকের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির মূল হাতিয়ার হয়ে ওঠে নিষেধাজ্ঞা। ২০০২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে জরিমানার অঙ্ক ৪০০ গুণ বেড়ে যায়। বড় বড় আন্তর্জাতিক ব্যাংক শত শত কোটি ডলার জরিমানার মুখে পড়ে, যেমন ২০১৪ সালে ফরাসি ব্যাংক বিএনপি প্যারিবাসকে ৯০০ কোটি ডলার দিতে হয়।

কিন্তু ২০১৯ সালের পর থেকে বড় অঙ্কের জরিমানা কমে গেছে। অর্থ পাচারের অভিযোগে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংককে প্রায় ১০০ কোটি ডলার জরিমানা করা হয়। ভয়ে ব্যাংকগুলো অর্থপ্রবাহ নজরদারিতে বিপুল অঙ্ক বিনিয়োগ করে। তবে এর ফলে অনেক সময় পুরো দেশকেও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়েছে।

২০২২ সালে রাশিয়ার ভিটিবি ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকে বের করে দেওয়া হয়। তাত্ত্বিকভাবে এটার ফলে তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভিটিবি চীনা পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম আলিপের মাধ্যমে প্রতিদিন ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত স্থানান্তরের বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। অর্থাৎ একধরনের ব্যাকডোর তৈরি হয়েছিল বৈশ্বিক লেনদেন ব্যবস্থায়।

পরবর্তীকালে সমালোচনার মুখে ভিটিবির ওয়েবসাইট থেকে আলিপে–সম্পর্কিত তথ্য সরিয়ে ফেলা হয়। তবে অনেক চীনা ছোটখাটো সংস্থা এখনো রাশিয়াকে অর্থ পারিশোধে সহায়তা করছে।

ক্ষমতার শেষ দিকে চীন–রাশিয়ার মধ্যে কিছু অর্থ লেনদেনের পথ বন্ধে উদ্যোগ নেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ জন্য তিনি ৯টি চীনা কোম্পানিকে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আনেন। তবে সেগুলো ছিল মূলত কাগুজে প্রতিষ্ঠান ও ছোটখাটো বাণিজ্যিক সংস্থা—আলিপের মতো বড় পেমেন্ট প্রতিষ্ঠান নয়।

গত এপ্রিলে মস্কোয় ব্যবসার বাজার জমজমাট ছিল। ‘এক্সপো ইলেকট্রোনিকা’ নামের বড় এক প্রযুক্তি মেলায় ছয় শতাধিক কোম্পানি অংশ নেয়। প্রদর্শনীতে ছিল উন্নত মানের সেমিকন্ডাক্টর, এলইডি স্ক্রিনে বিজ্ঞাপন চলছিল সেই চিপগুলোর, রাশিয়ায় যেসব চিপের রপ্তানি ঠেকাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। মেলায় রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদল ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ক্রেমলিনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়ন কর্মসূচির প্রধান ভাসিলি এলিস্ত্রাতভ।

প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল হংকংভিত্তিক অলচিপস; মাত্র আট মাস আগেই যারা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে। রাশিয়ার ক্রুজ মিসাইলে ব্যবহৃত হয়—এমন সব উপাদান বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি। সেই মিসাইল দিয়ে হামলা চালাচ্ছে ইউক্রেনের শহরগুলোয়।

অলচিপস কীভাবে অর্থ গ্রহণ করে—জানতে চাইলে কোম্পানির এক প্রতিনিধি হোয়াটসঅ্যাপে জানান, তারা আলিপের মাধ্যমে মার্কিন ডলার ও চীনা রেনমিনবি নেয়, কিংবা ভিটিবি ব্যাংকের হিসাবের মাধ্যমে সরাসরি ব্যাংক লেনদেন।

আলিপের স্বত্বাধিকারী অ্যান্ট গ্রুপ দাবি করেছে, অলচিপস তাদের গ্রাহক নয়। নিষেধাজ্ঞা চলাকালে কীভাবে ডলারের লেনদেন চলছে, সে বিষয়ে অলচিপস জবাব দেয়নি।

সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনে সহায়তার অভিযোগে চীনের দুটি আঞ্চলিক ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু এসব বৈশ্বিকভাবে কার্যকর করার মতো শক্তি ইউরোপের নেই। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক মারিয়া স্নেগোভায়া বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করার মতো তেমন কোনো ব্যবস্থা তাদের হাতে নেই।’

সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন কয়েকটি আঞ্চলিক চীনা ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক প্রভাবের দিক থেকে ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ নয়। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মারিয়া স্নেগোভায়ার মতে, নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার মতো তেমন একটা কার্যকর হাতিয়ার তাদের হাতে নেই।

Lading . . .