‘অক্সিজেন শেষ, টাকা পাঠাও’ বলে ১০ লাখ ইয়েন হাতিয়ে নিলেন ‘নভোচারী’
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অ্যানালগ-ডিজিটাল যুগ পেরিয়ে এখন এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ। আগের আমলের অনেক কায়িক শ্রমের কাজ এখন কম্পিউটার বা মোবাইলে ছোট বাক্য লিখে এন্টার চাপলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যাচ্ছে।
তা সত্ত্বেও, প্রতারকদের বুদ্ধিমত্তার যেন কমতি নেই। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা তাদের 'কৌশলকে' আরও কার্যকর করে চলেছেন।
এমনই এক অভিনব, কিন্তু মর্মান্তিক ঘটনায় প্রতারিত হয়ে লাখো ইয়েন হারিয়েছেন জাপানের এক বর্ষীয়ান নারী।
গত ২ সেপ্টেম্বর সিবিএস নিউজের প্রতিবেদনে এই 'প্রতিভাবান' প্রতারকের বিষয়ে জানা যায়।
স্থানীয় পুলিশ জানায়, অনলাইনে এক 'নভোচারী' ওই ৮০ বছর বয়সী নারীর প্রেমে পড়েন। মহাকাশযানের তথাকথিত বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য ওই ভুয়া নভোচারী ভুক্তভোগী নারীর কাছে সাহায্য চান।
গত জুলাইয়ে জাপানের হোক্কাইডো দ্বীপের সরলমনা নারীটির সঙ্গে সমাজমাধ্যমে ওই প্রতারকের পরিচয় হয়। এক স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, প্রতারক নিজেকে নভোচারী হিসেবে পরিচয় দেন।
পুলিশের দৃষ্টিতে এটি 'প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণার' ঘটনা।
বেশ কয়েকবার বার্তা বিনিময়ের পর প্রতারকটি একদিন জাপানি নারীকে লেখেন, 'আমি এই মুহূর্তে মহাকাশযানে আছি। আমরা হামলার শিকার হয়েছি। আমাদের অক্সিজেন ফুরিয়ে এসেছে।'
তারপর সেই বুদ্ধিমান প্রতারক ওই সহজ-সরল নারীর কাছে অক্সিজেন কেনার জন্য আর্থিক সাহায্য চেয়ে বসেন। বলেন, অনলাইনে তাকে অর্থ পাঠাতে। তার এই 'চাল' সফল হয়। তিনি ওই নারীকে বোকা বানিয়ে প্রায় ১০ লাখ ইয়েন বা ছয় হাজার ৭০০ মার্কিন ডলার হাতিয়ে নেন। এটি প্রায় আট লাখ ১৭ হাজার টাকার সমান।
একা থাকা ৮০ বছর বয়সী ওই নারী নিঃসঙ্গতা এড়াতে অনলাইনে বন্ধু খুঁজেন। অনলাইনে কথা বলে প্রতারককে ভালো লেগে যায় তার। প্রেমেও পড়েন তিনি।
তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
পুলিশের কর্মকর্তা সবাইকে সতর্ক করে বলেন, 'যদি আপনার সঙ্গে অনলাইনে পরিচয় হওয়া ব্যক্তি অর্থ চান, তাহলে বিষয়টি সন্দেহজনক। এ ক্ষেত্রে আপনি প্রতারিত হতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব, ঘটনার বিস্তারিত পুলিশকে জানান।'
বিশ্ব ব্যাংকের দেওয়া তথ্য বলছে—ছোট দেশ মোনাকোর পর জাপানেই সবচেয়ে বেশি প্রবীণ মানুষ বসবাস করেন। প্রতারকরা বেছে বেছে দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের ফাঁদে ফেলে। তারা প্রায়ই ছোট-বড় সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েন। এ ধরনের প্রতারণার ঘটনায় তাদের অনেকের বড় ক্ষতি হয়েছে।
প্রচলিত প্রতারণা কৌশলের মধ্যে আছে 'ইট'স মি' প্রতারণা—যেখানে কোনো ব্যক্তি অনলাইনে আপনার পরিবারের সদস্য সেজে অর্থ হাতিয়ে নেয়।
বাংলাদেশেও এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা শোনা যায়। অনেক সময় ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে কন্টাক্ট লিস্টের সবাইকে 'হ্যালো, বিপদে আছি। ২-৩ হাজার টাকা বিকাশ করে দাও' বা এ ধরনের বার্তা পাঠায় প্রতারকরা। কেউ কেউ সরল মনে যাচাই না করেই প্রতারককে অর্থ পাঠিয়ে দেয়। জাপানেও এ ধরনের প্রতারণার কমতি নেই।
বয়স্ক মানুষদের বিমা প্রিমিয়াম বা পেনশনের 'ভুয়া রিফান্ডের' কথা বলে এটিএম ব্যবহার করতেও প্রলুব্ধ করে প্রতারকরা। এ ক্ষেত্রে প্রতারক ফোনে তার 'শিকারকে' একের পর এক নির্দেশনা দিতে থাকে। বয়স্ক মানুষ খেই হারিয়ে ফেলে কী ঘটছে বোঝার আগেই দেখে নিজে রিফান্ড পাওয়ার বদলে প্রতারকের অ্যাকাউন্টে তার সর্বস্ব ট্রান্সফার হয়ে গেছে! এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে বলে সিবিএসের অপর এক প্রতিবেদনে জানা যায়।
জাপান টুডে'র এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এ ধরনের ঘটনা এতোই বেড়েছে যে ওসাকায় ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের এটিএম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা নিয়েও আলোচনা চলছে।
বিশ্বজুড়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণার ঘটনা দিনে দিনে বাড়ছে। ২০২৩ সালে ৬৪ হাজারেরও বেশি মার্কিন নাগরিকের কাছ থেকে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকরা। এর চার বছর আগে সংখ্যাটি ছিল ৫০০ মিলিয়ন। মার্কিন কেন্দ্রীয় বাণিজ্য কমিশন এই তথ্য জানিয়েছে।
ডেটিং ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীদের ওপর পরিচালিত জরিপে জানা গেছে, অর্ধেকেরও বেশি মানুষ অন্তত একবার হলেও প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন।
কলোরাডোর ডেমোক্র্যেট প্রতিনিধি ব্রিটানি পিটারসেন জানান, এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো দায় এড়াতে পারবে না।
গত বছর সিবিএসকে ক্যালিফোর্নিয়ার রিপাবলিকান প্রতিনিধি ডেভিড ভালাদাও বলেন, 'প্রতারক চিহ্নিত করার জন্য আপনার প্রযুক্তি যতই আধুনিক হোক না কেন, তারা আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে প্রতারিত করতে থাকবে এবং বিষয়টির দিকে আমাদের এখন বড় আকারে নজর দেওয়ার সময় এসেছে।'