প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

দেশের মোট উৎপাদনের শতকরা ৬৮ ভাগের জোগান দেওয়া বরিশাল অঞ্চলেই এখন মিলছে না ইলিশ। নদী-সাগর থেকে যেন হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে এই রুপালি সম্পদ। ভরা মৌসুমেও ইলিশ না পাওয়ার কারণ হিসাবে বেপরোয়া ফিশিং ট্রলি, সূক্ষ্ম জালে মাছ ধরা, মোহনায় জেগে ওঠা ডুবোচর আর ইলিশের প্রবেশমুখে ভারী কলকারখানা গড়ে ওঠাকে দায়ী করছেন সবাই। এছাড়া ভারতে ইলিশ রপ্তানিকেও দুষছেন কেউ কেউ। রপ্তানির অনুমতির পর একশ্রেণির ব্যবসায়ী মজুত করায় সংকট আরও তীব্র হয়েছে। ফলে দামও বাড়ছে হু-হু করে। রোববার বরিশালের পাইকারি বাজারে কেজি আকারের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ২৮শ থেকে ৩ হাজার টাকায়। পরিস্থিতি এমন যে, মাসেও এক টুকরো ইলিশ জুটছে না সাধারণ মানুষের পাতে।
জানা যায়, বছরের আষাঢ় থেকে আশ্বিন পর্যন্ত ইলিশের মৌসুম। এই সময়ে নদী-সাগরে মেলে বিপুল ইলিশ। কিন্তু এ বছর মৌসুমের প্রায় ৩ মাস পেরোলেও ইলিশের দেখা মিলছে না। নদীতে কিছু ধরা পড়লেও মোহনা কিংবা সাগরে নেই ইলিশ। বরিশাল ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ী জহির সিকদার বলেন, রোববার ৩শ মন ইলিশও আসেনি মোকামে। অথচ অন্যান্য বছর এই সময়ে কম করে হলেও দেড়-দুহাজার মন আসত। বর্তমানে যে ইলিশ আসছে তার প্রায় পুরোটাই স্থানীয় নদীর। সাগর থেকে আসছে না মাছ। আবার যেসব মাছ আসছে তার প্রায় সবই ছোট সাইজ। রোববার মোকামে আসা ইলিশের মধ্যে কেজি বা তার ওপরের সাইজের মাছ ছিল মাত্র ৮-১০ মন। ৭০-৮০ মন আছে ৭শ থেকে সাড়ে ৯শ গ্রাম ওজনের। বাকি পুরোটাই জাটকা।
একই খবর মিলেছে সাগর পাড়ের আলীপুর, পাথরঘাটা ও চরখালীসহ অন্যান্য মোকাম থেকে। পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গত বছর এই দিনে যেখানে ইলিশ এসেছিল ৫১৬ মেট্রিক টন। রোববার এসেছে মাত্র ২৩৫ মেট্রিক টনের কিছু বেশি। স্থানীয় ব্যবসায়ী নজরুল মুন্সি বলেন, বড় আকারের একটি ট্রলার ২০-২২ জন মানুষ নিয়ে সাগরে যায় মাছ ধরতে। ১০-১২ দিন সাগরে থাকলে জ্বালানি ও বাজার মিলিয়ে খরচ হয় ৮-১০ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ট্রলারগুলো এক-দেড় লাখ টাকার বেশি মাছ আনতে পারছে না সাগর থেকে। মাছ না মেলায় অনেক ব্যবসায়ী এখন আর ট্রলার পাঠাচ্ছে না সমুদ্রে। চরমন্তাজের ব্যবসায়ী মশিউর রহমান বলেন, সাগর উত্তাল থাকায় আষাঢ়-শ্রাবণের প্রায় পুরোটা সাগরে যেতে পারেনি ট্রলার। আর এখন ১২-১৫ দিন সাগরে থেকে মাছ না নিয়েই ফিরছে সেগুলো। লোকসান দিতে দিতে পথে বসে গেছে অনেক ব্যবসায়ী।
ইলিশ সংকটে চোখে অন্ধকার দেখছে গরিব জেলেরাও। চরখালী মোকামের শহিদ মাঝি বলেন, মাছের আমদানি ভালো হলে লাভের অংশ পাই। মাছ ধরা না পড়লে কেবল বেতন পাই। কয়েক মাস ধরে বেতন ছাড়া আর কিছুই জুটছে না। চাল-ডাল কিনে সংসার চালানোই মুশকিল। এখন মাছ ধরা ছেড়ে রিকশা চালাতে হবে।
যে কারণে নদী-সাগরে মিলছে না ইলিশ : বাংলাদেশ মৎস্য ট্রলার মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির কথা না ভেবে সাগরে অত্যাধুনিক ফিশিং ট্রলি দিয়ে মাছ ধরার অনুমতি দিয়েছে সরকার। এসব ফিশিং ট্রলি যে জাল ব্যবহার করে তাতে কেবল বড় মাছ নয়, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছোট রেণু-পোনাও আটকে যায়। নিয়মানুযায়ী উপকূল থেকে দেড়-দুইশ কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার কথা থাকলেও ফিশিং ট্রলিগুলো তা মানছে না।
কুয়াকাটা মৎস্য আড়তদার সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম খান বলেন, ফিশিং ট্রলির পাশাপাশি পাতাজাল, বেন্দিজাল, মশারি জাল আর চায়না দুয়ারিসহ বিভিন্ন সূক্ষ্ম ফাঁসের জাল দিয়ে মাছ ধরছে হাজার হাজার জেলে।
বরিশাল ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন বলেন, ফিশিং ট্রলি, সূক্ষ্ম ফাঁসের জাল আর জাটকা ইলিশ শিকার বন্ধ না করে সরকার দৌড়াচ্ছে মাছ ধরা বন্ধ রাখার পেছনে।
বরগুনার পরিবেশ আন্দোলনকর্মী আরিফুর রহমান বলেন, তালতলীতে ৩ নদীর মোহনা আর কলাপাড়ায় বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর মুখে গড়ে উঠেছে বড় আকারের দুটি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। নিয়মিত আসা-যাওয়া করছে কয়লাবাহী জাহাজ। উপকূলজুড়ে গড়ে উঠেছে আরও অনেক কল-কারখানা। এসব কারণে আমরা যেমন হারিয়েছি শান্ত উপকূল, তেমনি মাছও হারিয়েছে নিরাপদ পথ।
আকাশছোঁয়া দাম : বরিশাল মোকামের ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রাকৃতিক সংকটের সঙ্গে কৃত্রিম সংকটও কিন্তু চলছে। এর অন্যতম কারণ ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি। খুলনার এক রপ্তানিকারকসহ আরও কয়েকজন কদিন ধরে বাজার থেকে সংগ্রহ করছে ইলিশ। পূজায় ভারতে ১২শ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। সেজন্যই এই ইলিশ সংগ্রহ। এভাবে মজুতের কারণে যেটুকু ইলিশ আসছে তাও জুটছে না সাধারণের ভাগ্যে। ব্যবসায়ী গোপাল সাহা বলেন, রোববার পাইকারি বাজারে কেজি সাইজের ইলিশ প্রতি মন বিক্রি হয়েছে লাখ টাকা দরে। খুচরা বাজারে যার দাম গিয়ে দাঁড়াবে সোয়া লাখের ওপরে। এই হিসাবে প্রতিকেজি ইলিশের দাম পড়বে ৩ হাজার টাকারও বেশি।
বাজারের যখন এই অবস্থা তখন স্বভাবতই মধ্যবিত্ত আর নিম্ন আয়ের মানুষের ভাগ্যে জুটছে না ইলিশ। নগরীর বটতলার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ৪-৫শ গ্রামের একটা ইলিশের দামও হাজার টাকা। কবে ছেলেমেয়ের পাতে এক টুকরো ইলিশ দিতে পেরেছি তা মনে নেই।