হামলার প্রতিবাদে বরিশালে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি, ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট, ২০২৫

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকের ওপর হামলার প্রতিবাদে ধর্মঘট কর্মসূচি শুরু করেছেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। এতে জরুরি সেবা ছাড়া অন্যান্য সেবা বন্ধ রয়েছে। আজ সোমবার সকাল থেকে তাঁরা এ কর্মবিরতিতে যান। সেই সঙ্গে হাসপাতালের নিয়মিত চিকিৎসক ও অন্যরা আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার না করা হলে তাঁরাও কর্মবিরতিতে যাওয়ার সময়সীমা দিয়েছেন। ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার না করা হলে হাসপাতালের সর্বত্র তাঁরা কর্মবিরতি পালন করবেন।
স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার আন্দোলনকারী ব্যক্তিরা গতকাল রোববার দুপুরে হাসপাতালের মূল ফটকে বিক্ষোভকালে মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসা কর্মকর্তা দিলীপ রায়ের ওপর হামলা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ ধর্মঘটে নেমেছেন ইন্টার্ন চিকিসৎসকেরা। ইন্টার্ন চিকিৎসক নাজমুল হুদা বলেন, ‘আমরা চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ও দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে আন্দোলন করছি। আপাতত জরুরি সেবা চালু আছে, তবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় কোনো ব্যবস্থা না নিলে সব সেবা বন্ধ থাকবে।’
পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে নাজমুল হুদা আরও বলেন, ‘গতকাল রোববার দুপুরে হামলাকারীরা হাসপাতালে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে আতঙ্কজনক পরিবেশ তৈরি করেন। এ সময় আমাদের একজন চিকিৎসক ও দুজন কর্মচারীকে তাঁরা মারধর করেন। এতে রোগী ও চিকিৎসকেরা ভয় পেয়ে যান, চিকিৎসকদের অনেকে ভয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। আমরা স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের দাবির বিরোধী নই। বরং আমরা তা সমর্থন করি। তবে আমাদের নিরাপত্তা আজ চরম হুমকির মুখে। চিকিৎসক ও স্টাফদের ওপর বারবার হামলা হচ্ছে। বর্তমানে এই হাসপাতালে প্রায় ১৫০ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক কর্মরত।’
ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ধর্মঘট কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষার্থী প্রতিনিধি জুবায়ের মাহমুদ বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের আন্দোলনের সঙ্গে আমরা একমত এবং হাসপাতালের সংস্কার চাই। তবে আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে সাদা অ্যাপ্রনধারী চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফদের ওপর। এমনকি আমাদের শিক্ষার্থীদেরও হেনস্থা করা হয়েছে, ধাওয়া দেওয়া হয়েছে। সবশেষে আমাদের সম্মানিত শিক্ষক দিলীপ স্যারের ওপর হামলা হয়েছে। তাই আমরা ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি। তা না হলে আমরা ক্লাস ও ওয়ার্ড কার্যক্রম বর্জন করব।’
সোমবার বেলা একটার দিকে নগরের বান্দরোডে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে মানববন্ধন করেন চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। কর্মসূচি থেকে তাঁরা ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন। এর আগে দুপুর ১২টার দিকে হাসপাতালের তৃতীয় তলার সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁরা। এতে কর্মসূচির কথা জানান মিডলেভেল ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাখাওয়াত হোসেন।
শাখাওয়াত হোসেন বলেন, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক, ইন্টার্ন চিকিৎসক, নার্সিং অফিসার, টেকনোলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা একযোগে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কমপ্লিট শাটডাউনে যাওয়ার আগে সোম ও মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত হাসপাতালের সামনে নিরাপদ কর্মস্থলের দাবিতে এক ঘণ্টার শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। এই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসক ও কর্মচারীদের ওপর হামলাকারী দোষী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার না করা হলে কমপ্লিট শাটডাউন শুরু হবে।
এ সময় শাখাওয়াত হোসেন সতর্ক করে বলেন, ‘বরিশালবাসীর জনস্বাস্থ্য ও রোগীদের কথা বিবেচনা করে আমরা ৪৮ ঘণ্টা সার্ভিস চালু রাখব। তবে এ সময়ের মধ্যে হাসপাতালের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী বা স্থাপনার ওপর হামলা কিংবা কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে আমরা তাৎক্ষণিক কর্মবিরতিতে চলে যাব। এর দায় হামলাকারীদের ওপরই বর্তাবে।’
হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ স্টোর কর্মকর্তা চিকিৎসক আবদুল মুনেম বলেন, ‘জনস্বার্থে ৪৮ ঘণ্টার জন্য সব সেবা চালু থাকবে। তবে এ সময়ের মধ্যে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার না হলে সর্বত্র কর্মবিরতি দেওয়া হবে। আমরা রোগীদের কষ্ট দিতে চাই না, কিন্তু নিরাপদ কর্মপরিবেশ পেতে এর বিকল্প নেই।’
সংবাদ সম্মেলনের আগে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মশিউল মুনীর হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিনিধিদের নিয়ে জরুরি সভা করেন। সভা শেষে পরিচালকসহ সভায় উপস্থিত প্রতিনিধিরা সংবাদ সম্মেলন করেন। এরপর তাঁরা হাসপাতালের সামনে বান্দরোডে নিরাপদ কর্মস্থলের দাবিতে মানববন্ধন করেন।
এদিকে সোমবার স্বাস্থ্য সংস্কারসহ চার দফা দাবিতে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। ছাত্র-জনতার ব্যানারে ২১ দিন ধরে বরিশালে আন্দোলন চলছে। আন্দোলনে সংগঠক হিসেবে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৮ আগস্ট থেকে গত বুধবার পর্যন্ত ছয় দিনে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়ক সাড়ে ২৯ ঘণ্টা অবরোধ করেন আন্দোলনকারী ব্যক্তিরা। সেই সঙ্গে হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে কয়েকজন শিক্ষার্থী তিন দফা দাবি আদায়ে তিন দিন ধরে অনশন করছিলেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার বরিশালে আসেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু জাফর। তিনি ওই দিন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের সম্মেলনকক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, চিকিৎসক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনা করে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু আন্দোলনকারী ব্যক্তিরা স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বরিশালে না আসা পর্যন্ত আন্দোলন প্রত্যাহার করবেন না বলে জানান।
বৃহস্পতিবার দুপুরে হাসপাতালে অনশনকারী শিক্ষার্থীরা কয়েকজন কর্মচারীকে লাঞ্ছিত করেছেন, এমন অভিযোগে কর্মচারীরা একত্র হয়ে আন্দোলনকারী ব্যক্তিদের ধাওয়া দেন। এ সময় কয়েকজনকে মারধর করতেও দেখা যায়। পরে তাঁদের অনশন কর্মসূচি পণ্ড হয়ে যায়। এরপর গতকাল রোববার আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে যান এবং সেখানে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তাঁরা হাসপাতালের ভেতরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন এবং একজন চিকিৎসক ও দুজন কর্মচারীকে মারধর করেন বলে অভিযোগ ওঠে।
আন্দোলনকারী ব্যক্তিরা প্রথমে তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। দাবিগুলো হলো শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজসহ দেশের সব সরকারি হাসপাতালে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নিয়োগ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা; স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ দেশের সব হাসপাতালে দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি, দলীয় লেজুড়বৃত্তিক চিকিৎসকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ডিজিটাল অটোমেশন ও স্বচ্ছ জবাবদিহিমূলক টাস্কফোর্স গঠন এবং স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনকে জনগণের ভোগান্তির বিষয় শুনে তদন্ত সাপেক্ষে আবার সুপারিশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে জোর পদক্ষেপ নেওয়া। পরে বৃহস্পতিবার আন্দোলনকারী ব্যক্তিদের ওপর হামলার পর তিন দফার দাবির সঙ্গে অনশনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবিও যুক্ত করা হয়