গাছ নয়, যেন বিজ্ঞাপন সাঁটানোর ‘ফ্রি হোর্ডিং বোর্ড’
প্রকাশ: ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার প্রতিটি সড়কপথ যেন এখন এক একটি চলমান বিজ্ঞাপন কেন্দ্র। সড়কের দুই পাশে থাকা গাছের গোড়া থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত ঝুলে আছে নানা রঙের বিলবোর্ড। জীবন্ত গাছে নির্বিচারে পেরেক মেরে সাঁটানো হচ্ছে রাজনৈতিক দলের, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড।
পরিবেশ ও প্রকৃতির কথা চিন্তা না করে ঊর্ধ্বতন নেতাদের আশির্বাদ পাওয়ার আশায় এবং জনসম্মুখে নিজেকে রাজনৈতিক দলের নেতা বনে যাওয়ার অপচেষ্টায় গাছে গাছে সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড সাঁটাতে মগ্ন হয়ে পড়েছে নেতাকর্মীরা। চটপটির দোকান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, চিকিৎসকের সাইনবোর্ডও ঝুলছে জীবন্ত ওই গাছগুলোর গায়ে। আর ওইসব সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড গাছে সাঁটানো হচ্ছে বড় তারকাটা ও পেরেক মেরে। গাছগুলোর দিকে ভালভাবে তাকালে মনে হবে যেন প্রকৃতি নির্বাক হয়ে সহ্য করছে মানবসৃষ্ট ওই পেরেক সন্ত্রাস।
বেদনাদায়ক হলেও সত্য। খোদ চান্দিনা উপজেলা পরিষদের সামনে পেরেক মেরে গাছে সাঁটানো হচ্ছে এসব প্রচারসামগ্রী। অথচ প্রতিদিন প্রশাসনের লোক যাওয়া-আসা করছেন এ গাছের সামনে দিয়ে। বিশেষ করে থানা, উপজেলা পরিষদ, উপজেলা ভূমি অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ, স্কুল-কলেজ ও বিভিন্ন মোড়ের গাছে সাইনবোর্ড-বিলবোর্ড সাঁটানো আছে। এমনকি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও উপজেলা সদরের সড়ক বিভাজনে থাকা সৌন্দর্য বর্ধক গাছগুলোও ছাড় নেই। যা দেখে মনে হয়, গাছ নয়-বিজ্ঞাপন সাঁটানোর ‘ফ্রি হোর্ডিং বোর্ড’!
জীবন্ত গাছে পেরেক ঠোকা পরিবেশ ও বন আইনে স্পষ্টভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবুও এ বিষয়ে প্রশাসনের নজরদারি নেই বললেই চলে। প্রশাসন নীরব থাকায় কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে গাছকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিজ্ঞাপন সাঁটানোর মাধ্যম হিসেবে, ব্যানার সাঁটানোকে কেন্দ্র করে গাছের গায়ে ঠোকানো হচ্ছে বড় বড় পেরেক, যেগুলো গাছের অভ্যন্তরীণ কোষ ধ্বংস করে দেয়। এতে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে গাছ ধীরে ধীরে মরে যায়। যা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলা সদরের কেন্দ্রস্থল ছাড়িয়ে ছায়কোট-শ্রীমন্তপুর, বরকইট মাধাইয়া, নবাবপুর, কুটুম্বপুর-কালিয়ারচর ও চান্দিনা মোকামবাড়ি এবং বাড়েরা-মাইজখার সড়কপথের দু’পাশজুড়ে এই দৃষ্টিকটু চিত্র দেখা যাচ্ছে। যেখানে শত শত গাছ গায়ে পেরেক মেরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। পেরেকের যন্ত্রণা, সূর্যের তাপ ও জৈব ক্ষত একত্রে গাছগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করছে। অনেক গাছ ইতোমধ্যে শুকিয়ে গেছে, আরও অনেক গাছ তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে।
স্থানীয় পরিবেশ সচেতন মহল বিষয়টিকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে নগ্ন হামলা বলে আখ্যা দিয়েছেন। তারা বলছেন, একটা গাছ বড় হতে সময় লাগে ১৫-২০ বছর। অথচ একদিনের প্রচারণার জন্য সেই গাছকে পেরেক মেরে ধ্বংস করা হচ্ছে! এটা কেবল গাছ নয়, মানুষের বিবেকেরও মৃত্যু।
এ বিষয়ে জাতীয় পরিবেশ পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক মতিন সৈকত এআইপি (এগ্রিকালচারালি ইমপরটেন্ট পার্সন) বলেন- বৃক্ষ শুধু ফুল, ফল, ছায়া বা শীতল আশ্রয়স্থলই নয়, এটি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের অপরিহার্য উপাদান। বৃক্ষ পরিবেশকে সবুজ রাখে, অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং কার্বনডাইঅক্সাইড শোষণ করে। গাছের ওপর এমন নিরব নির্যাতন মোটেও সহ্য করার নয়। যারা নিজেদের প্রচার পত্র গাছের গাঁয়ে গেঁথে গাছকে মুমূর্ষূ করে তোলছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত এবং এই নির্যাতন রোধে প্রশাসনের প্রচার প্রচারণা বৃদ্ধি করা জরুরি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ আশরাফুল হক জানান, গাছে পেরেক ঠোকানো নিষেধ, যে জীবন্ত গাছ গুলোতে পেরেক ঠোকিয়ে প্রচারসামগ্রী লাগানো হয়েছে খুঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।