কথা রাখলেন না উপদেষ্টা, ৪১% ট্যারিফ কার্যকর
প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
-68c9cc983c117.jpg)
কথা রাখলেন না নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। এমন অভিযোগ চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী আমদানি-রপ্তানি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী নেতাদের অনেকের। তারা যুগান্তরকে বলেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপদেষ্টা কথা দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়-এমন কোনো ট্যারিফ বসাবেন না। প্রয়োজনে তিনি পুনরায় বৈঠক করে ব্যবসায়ী সংগঠনের দেওয়া প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করবেন। সব পক্ষের জন্য মঙ্গলজনক হয়-এমন সিদ্ধান্তই তিনি নেবেন। কিন্তু সব আশা-ভরসা আর ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক মতামতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি ৪১ শতাংশ ট্যারিফই বহাল রেখেছেন। এমনকি রোববার এ বিষয়ে গেজেট জারি করে সোমবার থেকে তা কার্যকর করা হয়।
এ ঘটনায় মঙ্গলবার যুগান্তরের কাছে ব্যবসায়ী নেতাদের কয়েকজন ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএএ) চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ‘বন্দর ব্যবহারকারী সব সেক্টরের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে নৌপরিবহণ উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেছিলেন তিনি প্রস্তাবিত ৪১ শতাংশ ট্যারিফ পুনর্বিবেচনা করবেন। ব্যবসায়ী বা সাধারণ ভোক্তাদের ক্ষতি হয়-এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না। ব্যবসায়ীরা ১০ থেকে ১২ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধির পক্ষে মত দেন। এ বিষয়ে তাদের কাছ থেকে প্রস্তাবনাও চাওয়া হয়। তারা লিখিত প্রস্তাবনা দেন। কিন্তু কোনো কিছুকে গুরুত্ব না দিয়ে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ আরোপ করে তা কার্যকর করে ফেলল বন্দর কর্তৃপক্ষ। এই গেজেট দেখে ব্যবসায়ীরা বিস্মিত, হতবাক ও চরম ক্ষুব্ধ।’ তিনি বলেন, ‘এটাই যদি করবেন তবে উপদেষ্টা মহোদয় সারা দেশের ব্যবসায়ীদের কেন ডেকেছিলেন। তাদের মতামতই বা কেন নিলেন। এতে ব্যবসায়ীদের হেয় করা হলো। উপদেষ্টা কথা দিয়ে কথা রাখলেন না।’
সূত্র জানায়, বেশ কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কনটেইনার হ্যান্ডলিংসহ বন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন খাতে গড়ে ৪১ শতাংশ বাড়তি ট্যারিফ বা মাশুল আরোপের প্রস্তাব করে, যা নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদনও করে। কিন্তু আমদানি, রপ্তানিকারকসহ ব্যবসায়ীরা এই ট্যারিফকে অস্বাভাবিক উল্লেখ করে প্রবলভাবে আপত্তি জানান। এ পরিপ্রেক্ষিতে মাশুল পুনর্বিবেচনার জন্য ২৫ আগস্ট নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, লাইটার জাহাজ অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)-সহ বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সেক্টরের ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে নৌপরিবহণ উপদেষ্টা জানান, ৫ সেপ্টেম্বরের পর তিনি পুনরায় বৈঠক করবেন। বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে ব্যবসায়ীদের মতামতের ভিত্তিতে সহনীয় পর্যায়ে মাশুল নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু ১৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামানের স্বাক্ষরে গেজেট আকারে প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে ৪১ শতাংশ মাশুল কার্যকর করার কথা বলা হয়। এমনকি সোমবার থেকে বাড়তি এ মাশুল কার্যকর করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘যারা ৪১ শতাংশ ট্যারিফ প্রস্তাব করেছিল, তাদের কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য বোঝেন বলে আমার মনে হয় না। যদি বুঝতেন তাহলে তারা এমন অস্বাভাবিক ট্যারিফ প্রস্তাব ও কার্যকর করতেন না। তিনি মনে করেন, নতুন ট্যারিফ কার্যকর করার কারণে আমদানি-রপ্তানি ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এর ফলে পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি ও প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। এ খাতের বেশকিছু পণ্য বা কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। আবার তৈরি করা সেই পোশাক রপ্তানি করতে হয়। তিনি বলেন, পোশাক মালিককে একেকটি কনটেইনারে ৫ হাজার টাকা বাড়তি ব্যয় করতে হবে। এ কারণে চাপ অনেক বাড়বে। মাহফুজুল হক শাহ বলেন, ‘আমি প্রস্তাব করব, প্রয়োজনে সরকার আবারও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসুক। ট্যারিফ পুনর্বিবেচনা করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’ তিনি বলেন, সমুদ্রপথে আমদানি-রপ্তানির ৯৯ শতাংশই হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। গত ৫৪ বছরে বন্দর কোনো লোকসান করেনি। এরপরও কেন এভাবে অস্বাভাবিক ট্যারিফ বৃদ্ধি করা হলো।
আরেক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ভোগ্যপণ্যের অনেক আইটেম আছে যেগুলো আমাদানির ওপর নির্ভর। ট্যারিফ বৃদ্ধির কারণে কেবল আমদানি-রপ্তানিকারক নন; ভোক্তারাও অর্থনৈতিক চাপে পড়বেন। আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বাড়বে। সব মিলিয়ে নতুন ট্যারিফ অর্থনীতিকে অস্থির অবস্থায় নিয়ে যাবে।
নতুন ট্যারিফে যা দিতে হচ্ছে : কার্যকর হওয়া মাশুল পর্যালোচনা করে দেখো গেছে, সবচেয়ে বেশি মাশুল বাড়ানো হয়েছে কনটেইনার পরিবহণে। বর্তমানে ২০ ফুট সমমানের প্রতিটি কনটেইনারে গড়ে ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা মাশুল আদায় করা হয়। নতুন প্রস্তাব কার্যকর হওয়ায় কনটেইনার প্রতি বাড়তি মাশুল দিতে হচ্ছে গড়ে ৪ হাজার ৩৯৫ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি আমদানি কনটেইনারে মাশুল বেড়েছে ৫ হাজার ৭২০ টাকা এবং রপ্তানি কনটেইনারে বাড়বে ৩ হাজার ৪৫ টাকা। এছাড়া পোর্ট ডিউস, টাগ চার্জ, হায়ার অব টাগস, বার্থিং-আনবার্থিং চার্জ, ওয়াটার সাপ্লাই চার্জ, বার্থ অকুপেন্সি, মর্নিং অকুপেন্সি, জেটি ক্রেন চার্জ, কি গ্যান্ট্রি ক্রেন, রিভার ডিউজ, ল্যান্ডিং অর শিপিং চার্জ, হোস্টিং চার্জ, হায়ার অব মেকানিক্যাল ইকুইপমেন্টস অ্যাপ্লায়েন্স অ্যান্ড ভেহিক্যালস চার্জসহ অর্ধশতাধিক খাতে বন্দরে বর্ধিত মাশুল আদায় করা হচ্ছে, যা অনেকক্ষেত্রে এখন দ্বিগুণ।
এদিকে ব্যবসায়ীদের মতামত উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম বন্দরে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ কার্যকর করার বিষয়ে জানতে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন প্রতিবেদক। তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি। এ কারণে মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য দেওয়া সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন