প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

আদি নাম ছিল নারিকেল জিঞ্জিরা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে নারিকেল জিঞ্জিরার বদলে হয়ে ওঠে সেন্টমার্টিন। এখন প্রবালের কৌলীন্য হারিয়ে হয়ে পড়ছে সাধারণ একটা দ্বীপে।
এক সময় সেন্টমার্টিন ছিল মাছ ধরার স্বর্গরাজ্য। স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর প্রবাল প্রাচীর ঘেরা এই দ্বীপের প্রায় প্রতিটি বাসিন্দার জীবন ও সংস্কৃতি মিশে ছিল সাগরের সঙ্গে। মাছ ধরা শুধু তাদের জীবিকা ছিল না, ছিল উৎসব আর ঐতিহ্যের অংশ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই ছবি এখন ফিকে হয়ে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, মাছের সংকটসহ নানা কারণে দ্বীপবাসীর পেশা বদলে গেছে। আজ তাদের মূল আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে পর্যটন। তবে বছরে মাত্র তিন মাসের পর্যটন সুযোগ থাকায় জীবিকা নিয়ে চরম সংকটে পড়েছেন সেন্টমার্টিনবাসী।
দ্বীপের ৭০ বছরের নুরুল ইসলাম জানান, কয়েক বছর আগেও ৮০ শতাংশ মানুষ সরাসরি মাছ ধরা বা মাছ বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নারী-পুরুষ সবাই কমবেশি কোনো না কোনোভাবে মাছ ধরার কাজ করতেন। এখন সেই সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। দ্বীপে পর্যটনের প্রসার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ধীরে ধীরে পেশা বদলে নিচ্ছে। নৌকায় পর্যটক ভ্রমণ, গাইডের কাজ, খাবারের দোকান বা হোটেল-রিসোর্টে চাকরি এসব হয়ে উঠেছে নতুন আয়ের উৎস।
স্থানীয় জেলেরা বলছেন, সাগরে এখন আগের মতো মাছও পাওয়া যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, মাছ ধরায় নানা বিধিনিষেধ, আর সমুদ্রে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার কারণে মাছ ধরা আর লাভজনক নয়। অন্যদিকে পর্যটন দ্রুত বাড়ছে। প্রতিদিন হাজারো পর্যটক সেন্টমার্টিনে ভিড় করছেন। এতে সেবা খাতে সুযোগ বেড়েছে বহুগুণে। জেলে পরিবারগুলো আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য পর্যটননির্ভর কাজে ঝুঁকছেন। পর্যটন ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম বলেন, বছরে তিন মাসের বেশি সেন্টমার্টিনে পর্যটনের সুযোগ দেয় না সরকার। রয়েছে নানা বিধিনিষেধ। এতে টানা ৯ মাস হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ পর্যটনকেন্দ্রিক সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ফলে ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের জীবনযাপন হুমকির মুখে পড়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরো দ্বীপের অর্থনীতি এককভাবে পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া ভবিষ্যতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। পর্যটন মৌসুমে আয় থাকলেও মৌসুম শেষে কর্মসংস্থান হ্রাস পায়। অনেকে তখন বেকার হয়ে পড়েন। একই সঙ্গে পর্যটনের চাপ দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সাগর ও প্রবালপ্রাচীরের ক্ষতি হলে তা দীর্ঘমেয়াদে জেলেদের পুরোনো জীবিকা ফিরে পাওয়াকে আরও কঠিন করে তুলবে।
দ্বীপের বাসিন্দা আমির আলী বলেন, পেশা বদলের কারণে এখন প্রায় সময় দুর্ভিক্ষ ভর করে বসে সেন্টমার্টিনবাসীর জীবনে। বর্ষায় সাগর উত্তাল হলে কিংবা পর্যটন মৌসুম বন্ধ থাকলে দ্বীপে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়। তখন পরিবারের চুলায় হাঁড়ি বসানোই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা ঝালমুড়ি বিক্রেতা আজিজুর রহমান আজিজের দাবি, দ্বীপের বাসিন্দারা যেন নিজ দেশে প্রবাসী। বাড়ি নির্মাণের জন্য টিন এমনকি পলিথিনও টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে আনতে পারেন না প্রশাসনের বাধার কারণে। আজিজ বলেন, অন্যদিকে প্রভাবশালী বড়লোকরা ইট-পাথরের বহুতল ভবন নির্মাণে সব ধরনের নির্মাণসামগ্রী ঠিকই আনতে পারছেন।
আয়েশা খাতুন নামে এক নারী বলেন, আগে আমরা মাছ শুকিয়ে বাজারে বিক্রি করতাম। এখন পর্যটক মৌসুমে দোকান চালাই। কিন্তু মৌসুম শেষ হলে কী করব-এই দুশ্চিন্তা থেকেই যায়।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফজুল ইসলাম বলেন, পর্যটন থেকে কিছুটা আয় হলেও দ্বীপবাসীর জীবন এখনো অনিশ্চিত। পর্যটন মৌসুম শেষ হলে অনেক পরিবার কষ্টে দিন কাটায়। টেকসই কোনো পরিকল্পনা ছাড়া, সেন্টমার্টিনবাসী আরও বিপদের মুখোমুখি হবে। আমরা সরকারের কাছে অন্তত চার মাস পর্যটন খোলা রাখার দাবি জানাচ্ছি।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহাসান উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, সেন্টমার্টিনে তালিকাভুক্ত জেলের সংখ্যা ৭৯৯ জন। এসব জেলে সরকারি নানা সুবিধা নিয়মিতভাবে পাচ্ছেন। বিধিনিষেধ না থাকলে কিংবা সাগর উত্তাল না হলে জেলেদের মাছ ধরায় কোনো বাধা দেওয়া হয় না। তিনি আরও বলেন, বাসিন্দাদের জীবিকা নির্বাহের বিকল্প পথ তৈরি করতে সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ব্র্যাকসহ বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে স্থানীয়দের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সেন্টমার্টিনে খাদ্য, সবজি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে প্রশাসনের অনুমতি বা বাধার প্রসঙ্গে ইউএনও বলেন, এটি সত্য নয়। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুধু নির্মাণসামগ্রী আনতে অনুমতি নিতে হয়, কারণ সেখানে ইট-পাথরের অবকাঠামো নির্মাণ পরিবেশগত কারণে নিষিদ্ধ রয়েছে।