কক্সবাজারে জমি নিবন্ধনে (রেজিস্ট্রি) নির্ধারিত উৎসে কর নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট, ২০২৫

কক্সবাজারে জমি নিবন্ধনে (রেজিস্ট্রি) নির্ধারিত উৎসে কর নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। কিছু ক্ষেত্রে জমির বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি টাকা আসছে উৎসে কর বাবদ। ফলে অনেকেই জমি নিবন্ধন না করে বিকল্প পথে (বায়নানামা, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি, হেবা) জমি হস্তান্তর করছেন। এতে সরকারও বড় অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ২৪ জুন এক প্রজ্ঞাপনে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) আওতাধীন ৯টি উপজেলা ও ৪ পৌরসভার ৬৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জমি নিবন্ধনের নতুন উৎসে কর নির্ধারণ করে। নাল জমিতে শতকপ্রতি ২৫ হাজার, আবাসিক জমিতে ৫০ হাজার এবং ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা উৎসে কর বাধ্যতামূলক করা হয়। গত ১ জুলাই থেকে তা কার্যকর হওয়ার পর নিবন্ধন ব্যাপকভাবে কমে গেছে। তবে আগে এই উৎসে কর ছিল জমির শ্রেণিভেদে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা।
কক্সবাজার সদর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত জেলা রেজিস্ট্রার) জাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন প্রজ্ঞাপনে উৎসে কর অতিরিক্ত হওয়ায় গত জুলাই মাসে জমির নিবন্ধন (সাবকবলা রেজিস্ট্রি) ৪৫ শতাংশ কমে গেছে। কউক অধিভুক্ত ৬৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকার বেশির ভাগ প্রত্যন্ত অঞ্চল পড়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজনকেও শহরের মতো অতিরিক্ত উৎসে কর পরিশোধ করতে হচ্ছে।
সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্র জানায়, জুন মাসে আটটি সাবরেজিস্ট্রি অফিসে উৎসে কর আদায় হয়েছিল ১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, জুলাইয়ে তা নেমে এসেছে ৬৫ লাখে। এক মাসে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে এক কোটির বেশি।
কক্সবাজার জেলা দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন মিজান বলেন, ২ হাজার ৪৪৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই জেলায় মৌজা আছে ১১৮টি। এর মধ্যে কউক অধিভুক্ত ৮১ মৌজায় জমি পড়েছে ৬৯০ বর্গকিলোমিটার। শহর, উপশহর, গ্রাম ও চরাঞ্চলের জমির বাজারমূল্যে তারতম্য রয়েছে। অথচ উৎসে কর নির্ধারণ করা হয়েছে এক হারে। এতে সাবকবলা দলিলে ভাটা পড়েছে। অঞ্চলভিত্তিক উৎসে কর নির্ধারণ করা উচিত।
বিপাকে সাধারণ মানুষ
পিএমখালী ইউনিয়নের কৃষক ছৈয়দ করিম বলেন, মেয়ের বিয়ের খরচ জোগাতে ১৪ শতক জমি বিক্রির চুক্তি করেছিলেন ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। কিন্তু নিবন্ধন করতে গিয়ে জানতে পারেন উৎসে করই লাগবে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা (প্রতি শতক ২৫ হাজার টাকা)। তিনি বলেন, ‘এটা কেমন নিয়ম। এমন নিয়মে জমি বিক্রি করে কীভাবে মেয়ের বিয়ে দেব?’
কুতুবদিয়ার নুরুল ইসলামের স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য জমি বিক্রি করতে গিয়ে তিনি দেখেন, ১২ লাখ টাকার জমির নিবন্ধনে উৎসে কর দিতে হবে ১০ লাখ টাকা। টেকনাফ পৌর এলাকার ব্যবসায়ী নুরুল আমিন বলেন, ‘৮ শতক জমি বিক্রি করলে পুরো টাকাই চলে যাবে উৎসে করে। সরকারের এ সিদ্ধান্তে ওমরাহযাত্রা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।’
কুতুবদিয়ার কৈয়ারবিল গ্রামের কৃষক খলিল আহমদ বলেন, সমুদ্র উপকূলের এক একর (১০০ শতক) জমি বাজারমূল্য এখন পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা। কিন্তু ওই জমি বিক্রি করলে উৎসে কর দিতে হবে ২৫ লাখ টাকা।
এ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত জেলা রেজিস্ট্রার জাহিদুর রহমান বলেন, ‘নতুন উৎসে করের প্রভাব, সাবকবলায় জমি নিবন্ধন ও সরকারি রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার বিষয়টি আমরা নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শককে লিখিতভাবে জানিয়েছি। তিনি (মহাপরিদর্শক) অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের শীর্ষ মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টির সুরাহার চেষ্টা চালাচ্ছেন।’
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘উৎসে কর নিয়ে সমস্যার কথা শুনেছি, সমাধানের চেষ্টা চলছে।’
আন্দোলনে সামাজিক সংগঠনগুলো
অতিরিক্ত উৎসে কর কমানোর দাবিতে এক মাস ধরে কক্সবাজার শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় মানববন্ধন ও সমাবেশ হচ্ছে। ২০ আগস্ট ‘সেভ দ্য কক্সবাজার’–এর ব্যানারে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বরে আয়োজিত সমাবেশে বক্তারা দ্রুত এই নীতি সংশোধনের দাবি জানান।
কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র সরওয়ার কামাল বলেন, ‘জমি নিবন্ধনের নামে কক্সবাজারবাসীর ওপর রক্তচোষা নীতি চাপানো হয়েছে, তা দ্রুত সংশোধন করতে হবে।’
গবেষক মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আগে শতকপ্রতি ২–৫ হাজার টাকা উৎসে কর দিতে হতো। এখন তা বেড়ে ২৫ হাজার। এতে মানুষ বৈধ পথে নিবন্ধনের পরিবর্তে বিকল্প উপায় নিচ্ছেন।’
অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক মকবুল আহমদ বলেন, অতিরিক্ত উৎসে কর কক্সবাজারবাসীর প্রতি বৈষম্য। তাতে নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
অতিরিক্ত উৎসে কর দ্রুত সংশোধনের দাবি জানিয়ে সমাবেশে বক্তব্য দেন কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সদস্যসচিব জাহাঙ্গীর আলম, কক্সবাজার জেলা দলিল লেখক সমিতির সভাপতি আবুল হোছাইন, নাগরিক সংগঠন ‘আমরা কক্সবাজারবাসী’র সদস্যসচিব নাজিম উদ্দিন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার সদর উপজেলা সভাপতি এনামুল হক চৌধুরী, মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারস ফোরামের সদস্যসচিব মিজানুর রহমান, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান প্রমুখ।
তাঁদের দাবি, অঞ্চলভেদে জমির বাজারদর অনুযায়ী উৎসে কর নির্ধারণ না করলে জমি নিবন্ধন কার্যক্রম পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।