Advertisement

কক্সবাজারে পর্যটকদের মন জয় করেছে বইবিপণি ইস্টিশন

প্রথম আলো

প্রকাশ: ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

কক্সবাজারের সাগর পাড়ের বইয়ের দোকান ইস্টিশনছবি: প্রথম আলো
কক্সবাজারের সাগর পাড়ের বইয়ের দোকান ইস্টিশনছবি: প্রথম আলো

সারা দিন সাগরের নোনাজলে দাপাদাপির পর বিকেলে ভিন্ন অভিজ্ঞতা চান কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকেরা। বৈচিত্র্যের খোঁজে শপিং কিংবা রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়া বেছে নেন বেশির ভাগ পর্যটক। কিন্তু তাতেও যাঁদের মন ভরে না, ইস্টিশন হতে পারে তাঁদের গন্তব্য। এই ইস্টিশন থেকে ক্ষণে ক্ষণে ছেড়ে যায় জমজমাট আড্ডার গাড়ি। শিল্প-সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা যেকোনো বিষয় নিয়ে একবার আড্ডা শুরু হলে আর কি থামাথামি আছে? বেলাভূমির ঝিরি ঝিরি বাতাস, সাগরের গর্জন শুনতে শুনতে বই হাতে ইস্টিশনে বসলে আর উঠতেই ইচ্ছা হবে না।

কক্সবাজার সৈকতের লাবণী পয়েন্টের ছোট পরিসরের বইয়ের দোকান ইস্টিশন। এখান থেকে পছন্দের বই তো কেনা যাবেই, পাশাপাশি বসে বই পড়া, পাঠচক্র, আড্ডা-আলোচনা, গান-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে পর্যটকদের। আর এই বইয়ের দোকান ঘিরে বছরব্যাপী সৈকতে বইমেলা, সাহিত্য আড্ডা, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, বসন্ত বরণের মতো নানা আয়োজন লেগেই থাকে। সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে ইস্টিশনে পা রাখলেই হয়তো কানে আসবে গান কিংবা আবৃত্তির শব্দ। সব মিলিয়ে সৈকতের পরিবেশে অনন্য এক অভিজ্ঞতাই হবে।

যেভাবে ইস্টিশনের যাত্রা শুরু

ইস্টিশনের ‘মাস্টার’ অর্থাৎ স্বত্বাধিকারী হলেন অনুরণন সিফাত। জন্ম বান্দরবানের লামা উপজেলায়। শৈশব-কৈশোর কেটেছে সেখানকার ‘সুখ’ও ‘দুঃখ’ নামের পাশাপাশি দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে মাতামুহুরী নদীর বয়ে চলা দেখে। মাধ্যমিকের গণ্ডি শেষ করে সিফাত পা রাখেন চট্টগ্রাম নগরে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে যোগ দেন বেসরকারি একটি সংস্থায়। কক্সবাজারে চাকরির সুবাদে এসে ইস্টিশন গড়ে তোলার ঝোঁক চাপে তাঁর মাথায়।

অনুরণন সিফাত বলেন, ২০১৮ সালে কক্সবাজার সৈকত শহর ঘুরে দেখলাম কয়েক শ হোটেল-রেস্তোরাঁ আছে। লাখো পর্যটকের সমাগম। পা রাখার জায়গা থাকে না। কিন্তু সৈকত এলাকার কোথাও বইয়ের দোকান নেই। লাখ লাখ পর্যটক আর শহরের হাজারো শিক্ষার্থী বই পড়তে পারছে না। তখন এই শূন্যতা পূরণের তাগিদ জেগে ওঠে।

হাতে তেমন টাকা ছিল না সিফাতের। বেতনের টাকায় ২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি, শহরের হাসপাতাল সড়কে ছোট্ট একটা জায়গায় শুরু হলো ইস্টিশনের যাত্রা। কিছুদিনে মধ্যে বিপুল সাড়া। আশপাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী-শিক্ষক ছাড়াও সাহিত্যপ্রেমীদের আনাগোনা বেড়ে গেল। সৃজনশীল মানুষদের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয় ইস্টিশন।

কিন্তু দুই বছরের বেশি সেখানে চালানো গেল না দোকানটি। সড়ক সম্প্রসারণের জন্য উঠিয়ে দেওয়া হয় দোকানটি। জায়গা পরিবর্তন করে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে চলে আসে ইস্টিশন। স্থানীয় সাহিত্যপ্রেমীদের পাশাপাশি পর্যটকেরাও আসতে লাগলেন এবার। তৈরি হলো নতুন মেলবন্ধন।

সম্প্রতি ইস্টিশনে ঢুঁ মেরে দেখা গেল, কয়েকজন তরুণ-তরুণী বসে বই পড়ছেন। চায়ের আড্ডায় দেশের রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে চলছে আলোচনা। পর্যটকেরাও এসেছেন বই কিনতে।

ইস্টিশনের ‘মাস্টার’ অর্থাৎ স্বত্বাধিকারী হলেন অনুরণন সিফাত। জন্ম বান্দরবানের লামা উপজেলায়। শৈশব-কৈশোর কেটেছে সেখানকার ‘সুখ’ ও ‘দুঃখ’ নামের পাশাপাশি দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে মাতামুহুরী নদীর বয়ে চলা দেখে। মাধ্যমিকের গণ্ডি শেষ করে সিফাত পা রাখেন চট্টগ্রাম নগরে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে যোগ দেন বেসরকারি একটি সংস্থায়। কক্সবাজারে চাকরির সুবাদে এসে ইস্টিশন গড়ে তোলার ঝোঁক চাপে তাঁর মাথায়।

জানা গেল, ইস্টিশনে শিক্ষার্থীরা এককালীন ফি দিয়ে নিবন্ধিত হয়ে বই নিয়ে যেতে পারে। পড়ে ফেরত দিতে হয়। বর্তমানে এ ধরনের নিবন্ধিত পাঠকের সংখ্যা ৭০ জন। আর এসব পাঠকের জন্য নির্ধারিত বইয়ের সংখ্যা দুই শতাধিক।

বইয়ের আড্ডায় কথা হয় শিরু নামের এক তরুণীর। তিনি বলেন, ‘ইস্টিশন হচ্ছে কমিউনিটি লাইব্রেরি, বুক স্টল—সবকিছু। এখানে দারুণ আড্ডা হয়। বই আর আড্ডার টানেই নিয়মিত এখানে আসি।’

ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা পর্যটক সুলতানা মোর্শেদ ইস্টিশনের আড্ডায় জমে গেছেন। তিনি বললেন, ‘কক্সবাজার সৈকতে বেশ কয়েকবার আসা হয়েছে। কিন্তু কোথাও একটা পাঠাগার কিংবা বইয়ের দোকান না দেখে হতাশ হতাম। এবারের যাত্রায় ইস্টিশন দেখতে পেয়ে খুব ভালো লাগছে।’

ইস্টিশনকে কেবল বইয়ের দোকান বলতে চান না সিফাত। তিনি বলেন, ‘এটাকে বইবিপণি বললে ভুল বলা হবে। এটা একটা প্ল্যাটফর্ম। কিংবা বলতে পারেন কালচারাল হাব (সাংস্কৃতিক মিলনমেলা)। যেখানে শিল্প-সাহিত্যপ্রেমীদের মেলবন্ধন ঘটবে। সৃজনশীলতার লালন হবে, সুন্দরের চর্চা হবে।’

‘আমরা সবাই সবকিছু করছি। কিন্তু একজন আরেকজনের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলছি না। তাই চেয়েছি, এখানে এসে মানুষের সঙ্গে মানুষ কথা বলুক। আড্ডা দিক। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিক। সেই ইচ্ছার প্রতিফলন ইস্টিশন। পর্যটকসহ স্থানীয়রা আসছেন ইস্টিশনে। তাঁরা বই কিনছেন, বই পড়ছেন, আড্ডাও দিচ্ছেন।’
অনুরণন সিফাত, স্বত্বাধিকারী, ইস্টিশন

বই, চা, আড্ডা

ইস্টিশনের র‍্যাকে থরে থরে সাজিয়ে রাখা আছে দেশ-বিদেশের কয়েক হাজার বই। বিপণিটির বাইরে গাছের ছায়ায় পাতা চেয়ার-টেবিল। সেখানে চলে আড্ডা-গল্প, গান-কবিতা পাঠ। সঙ্গে গরম-গরম চা–কফি।

অনুরণন সিফাত বলেন, ‘আমরা সবাই সবকিছু করছি। কিন্তু একজন আরেকজনের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলছি না। তাই চেয়েছি, এখানে এসে মানুষের সঙ্গে মানুষ কথা বলুক। আড্ডা দিক। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিক। সেই ইচ্ছার প্রতিফলন ইস্টিশন। পর্যটকসহ স্থানীয় লোকজন আসছেন ইস্টিশনে। তাঁরা বই কিনছেন, বই পড়ছেন, আড্ডাও দিচ্ছেন।’

শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননের বিকাশে ইস্টিশনের উদ্যোগে পাঁচ বছর ধরে স্কুলভিত্তিক নানা কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। স্কুল পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বই পড়ার কার্যক্রম করছে ইস্টিশন। পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চল ও সুবিধাবঞ্চিত স্কুলগুলোতে পাঠাগার গড়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে বান্দরবানের লামা, আলীকদম, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, হবিগঞ্জ এবং গাইবান্ধার সাতটি স্কুলে পাঠাগার চালু হয়েছে। প্রতিটি লাইব্রেরিতে ইস্টিশনের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হয়েছে ১০ হাজার টাকা দামের ১০৭টি করে বই।

বাধা জয় করে

ইস্টিশনের পথচলা মোটেও সহজ ছিল না। অনুরণন সিফাত সে কথাই জানালেন দীর্ঘ আড্ডায়। বললেন, নারী হিসেবে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে। বাইরে থেকে আসা মেয়ে হিসেবে কিছু মানুষের বিরুদ্ধ স্রোতও সামলাতে হয়েছে। ইস্টিশনকেন্দ্রিক নারীদের আড্ডা বাঁকা চোখে দেখা হতো। কটূক্তি ছুড়তে দেরি হতো না। প্রথম আউটলেটটি কোনো নোটিশ ছাড়াই তুলে দেওয়া হয় রাস্তা সম্প্রসারণের কথা বলে। সেবার অনেক বই, প্রয়োজনীয় দলিল রক্ষা করা যায়নি। প্রায় তিন মাস বন্ধ রাখতে হয়েছিল ইস্টিশনের কার্যক্রম। নতুন আউটলেটটিতেও একবার চেয়ার, টব ভাঙচুর করে একদল লোক।

সিফাত বলেন, ‘নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও পাঁচ বছর টিকে আছে ইস্টিশন। সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরির প্রচেষ্টায় ইস্টিশন তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আশা করছি, সাগরের বিশালতায় ইস্টিশন টিকে থাকবে।’

Lading . . .