Advertisement

সাগরবেষ্টিত সন্দ্বীপ এক বঞ্চনার জনপদ

যুগান্তর

প্রকাশ: ১০ আগস্ট, ২০২৫

24obnd

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। মানুষের মৌলিক অধিকারের এই পাঁচটি অপরিহার্য অংশের মধ্যে তিনটিরই অভাব রয়েছে সন্দ্বীপের মানুষের। বাসস্থান নিয়ে এই দ্বীপের মানুষকে প্রতিনিয়ত ভাঙনের হুমকির মধ্যে থাকতে হয়। প্রয়োজনীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় এই দ্বীপের মানুষ উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত। এখানকার স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল। সাগর পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে যেতে হয় চিকিৎসার জন্য। পথেই প্রাণ দিতে হয় রোগীদের। বিশেষ করে বৃদ্ধ, শিশু ও প্রসূতিদের হয় প্রতিনিয়ত হয় করুণ পরিণতি।

সন্দ্বীপ চট্টগ্রাম জেলার আওতাধীন একটি উপজেলা। শহর থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপটির মানুষ যুগের পর যুগ এমন অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনা নিয়ে জীবনযাপন করছেন। ফলে এখানকার মানুষ বিদেশমুখী, চট্টগ্রাম শহরমুখী, এমনকি কখনো কখনো উদ্বাস্তু হয়ে জীবনযাপন করছেন। এক কথায় সন্দ্বীপ যেন এক বঞ্চনার জনপদ।

চট্টগ্রাম জেলার কুমিরা থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ। এটি বাংলাদেশের একটি প্রাচীন জনপদ। দিলাল রাজার স্মৃতিবিজড়িত সহস বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ এই দ্বীপে জন্ম নিয়েছেন মধ্যযুগের খ্যাতিমান কবি আব্দুল হাকিম, উপনিবেশ স্থাপন করেছে পর্তুগিজরা, আর ছুটে এসেছেন পর্যটক ও ইতিহাসবিদ ইবনে বতুতা ও সিজার ফ্রেডরিক। কাজী নজরুল ইসলামও পা রেখেছেন এই দ্বীপে। শক্তিশালী বাম রাজনৈতিক নেতা প্রয়াত কমরেড মুজাফফর আহমদের জন্মভূমি সন্দ্বীপ। দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার ১২ শতাংশের জোগান দেয় এখানকার মানুষ। এত কিছুর পরও যোগাযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাসহ বহু ক্ষেত্রে বঞ্চিত এই দ্বীপের বাসিন্দারা। ৭৬২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের বসবাস। দ্বীপটির ভূমি প্রতি বছরই পরিবর্তিত হয় সমুদ্রের ভাঙন ও নতুন চর জেগে ওঠার কারণে।

সন্দ্বীপের রাতের আতঙ্ক : সন্ধ্যার পর দ্বীপবাসী কার্যত মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাতে কোনো নৌযান চলে না। এ কারণে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনেও চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছানো দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। ৭ জুলাই ২০২৫ রাতে কালাপানিয়া ইউনিয়নের ১২ বছর বয়সি শিশু আবদুর রহমান অসুস্থ হয়ে পড়ে। সন্দ্বীপে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পাওয়ায় চট্টগ্রাম শহরে নিতে ১০ ঘণ্টা নৌযানের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। শেষ পর্যন্ত সকালে নৌযানে শহরের উদ্দেশে রওনা দিলে মাঝসাগরেই মৃত্যু হয় তার। গর্ভবতী নারীদের জন্যও সন্দ্বীপে নেই জরুরি সেবা। ১১ মে ২০২২ রাত ১০টায় সন্দ্বীপ পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের কুলসুমা বেগমের প্রসব বেদনা শুরু হলে তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎকরা রাত ৩টায় বলেন, তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। আরও ৩ ঘণ্টা ঘাটে অপেক্ষার পর ভোরে একটি নৌযানে চট্টগ্রাম শহরে প্রসূতিকে নিয়ে শহরে পৌঁছান স্বজনরা। কিন্তু হাসপাতালে ওই প্রসূতিকে মৃত ঘোষণা করা হয়। শুধু আবদুর রহমান বা কুলসুমা নয়, প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাব অথবা চিকিৎসার জন্য সাগর পাড়ি দিয়ে শহরে পৌঁছাতে না পেরে এভাবেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ঘটনা এখানকার নিয়মিত ঘটনা। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়োগ থাকলেও বেশির ভাগ সরকারি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকেন কর্মস্থলে।

সন্দ্বীপের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ইউনিয়ন উড়িরচর সন্দ্বীপ থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেখানকার ৪০ হাজার বাসিন্দার চিকিৎসার জন্য একজন ডাক্তারও নেই। উড়িরচরের একমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্র যা গত দুই দশক ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে পুলিশ ফাঁড়ি হিসাবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়াও ৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল রয়েছে। দুটি বেসরকারি ক্লিনিক এবং সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিকও রয়েছে। ভুক্তভোগীরা জানান, সরকারি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সন্দ্বীপে পোস্টিং হলেও থাকতে চান না।

উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে সন্দ্বীপ : সন্দ্বীপে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় কিছু অগ্রগতি থাকলেও উচ্চশিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষায় রয়েছে সীমাহীন সীমাবদ্ধতা। দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সাগরবেষ্টিত এই জনপদের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ খুবই সীমিত। বর্তমানে সন্দ্বীপে দুটি কলেজে মাত্র দুটি বিষয়ে স্নাতক (অনার্স) কোর্স চালু আছে। হাজী আবদুল বাতেন সরকারি কলেজে চালু রয়েছে বাংলা বিষয়ে অনার্স এবং মুস্তাফিজুর রহমান ডিগ্রি কলেজে রয়েছে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স। এর বাইরে অন্য কোনো বিষয়ের অনার্স চালু না থাকায় শিক্ষার্থীরা দ্বীপ ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে গিয়ে পড়াশোনা করতে বাধ্য হন। তবে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে এই সুযোগও সবার ভাগ্যে জোটে না।

শিল্পনগরীর উদ্যোগ ও সম্ভাবনার হাতছানি : সন্দ্বীপে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বিসিক শিল্পনগরী গড়ার পরিকল্পনা। ১০০ একরেরও বেশি জায়গাজুড়ে বিসিকের একটি শিল্প এলাকা তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পাশাপাশি প্রসেসিং ইউনিটও স্থাপনের কথা রয়েছে। এতে করে প্রবাসনির্ভরতা কমিয়ে দ্বীপের অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানে বড় পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

কৃষি ছেড়ে প্রবাস : একসময় এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা ছিল কৃষি। কিন্তু ভাঙন, লবণাক্ততা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উৎপাদনশীলতা কমে গেছে। বহু কৃষক তাদের পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন। যাদের ন্যূনতম সামর্থ্য রয়েছে তারা ছুটছেন বিদেশে। অন্যরা ঝুঁকছেন ক্ষুদ্র ব্যবসা ও পরিবহণের দিকে। বর্তমানের সন্দ্বীপের প্রতিটি পরিবারে গড়ে দুজন প্রবাসী রয়েছেন, যারা বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। কিন্তু অধিকাংশই অদক্ষ ও অল্পশিক্ষিত হওয়ায় কষ্টসাধ্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন। যেমন- নির্মাণ শ্রমিক, সাফাইকর্ম বা পরিবহণ খাতের কর্মী হিসাবে। ফলে একসময় পুরোপুরি কৃষিনির্ভর সন্দ্বীপে এখন জীবিকার রূপ পাল্টেছে।

ফেরি সার্ভিস চালুতে কিছুটা স্বস্তি : চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপে যোগাযোগের একমাত্র রুট কুমিরা-গুপ্তছড়া ও বাঁশবাড়িয়া গুপ্তছড়া ঘাট। বিআইডব্লিউটিসির একটি মাত্র জাহাজ এমভি মালঞ্চ চলাচল করে সন্দ্বীপে। দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা সন্দ্বীপের সন্তান ফাওজুল কবির খানের প্রচেষ্টায় সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম রুটে ফেরি চালু হওয়ায় যোগযোগ ব্যবস্থায় কিছুটা হলেও এসেছে স্বস্তি। এখন চট্টগ্রাম শহর থেকে সকালবেলা পণ্য নিয়ে দুপুরের আগেই সন্দ্বীপে পৌঁছানো যাচ্ছে। আবার সন্দ্বীপে উৎপাদিত সবজি ও কৃষিপণ্য সহজেই চলে যাচ্ছে মূল ভূখণ্ডে।

নতুন চর জাগাচ্ছে আশা : সন্দ্বীপের পশ্চিম উপকূলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জেগে উঠছে একের পর এক নতুন চর, যার মধ্যে চর জাহাইজ্যা (স্বর্ণদ্বীপ), ঠেঙ্গারচর (ভাসানচর) উল্লেখযোগ্য। নদী ও সাগরের পলি সঞ্চয়ে গঠিত এসব ভূমি পশুপালন, কৃষিকাজ এবং বসতির জন্য বিপুল সম্ভাবনা তৈরি করছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত নদীভাঙনে গৃহহীন সন্দ্বীপবাসীর জন্য এসব চর হতে পারে নতুন আশ্রয়স্থল। তবে এই সম্ভাবনার মাঝেও রয়েছে জটিলতা। সরকারি নীতিমতে, জেগে ওঠা নতুন চর প্রথমে ১ নম্বর খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করতে হয় এবং পরে ভূমিহীনদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এছাড়া, ভাসানচরে রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছে। এমন অবস্থায় সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেখানে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সম্ভব হবে কিনা তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। এদিকে সন্দ্বীপের জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর অধিকাংশই বসতভিটা হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তারা চায়, নতুন জেগে ওঠা চরের বৈধ বরাদ্দ। এ অবস্থায়, যথাযথ জরিপ, স্বচ্ছ বন্দোবস্ত প্রক্রিয়া ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে চরগুলোকে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য পরিকল্পিত পুনর্বাসন অঞ্চলে রূপান্তর করা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

কী ভাবছেন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান : সন্দ্বীপের সংকট ও সম্ভাবনার বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সন্দ্বীপের সন্তান ফাওজুল কবির খান যুগান্তরকে বলেন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রবাসী নির্ভরতার পাশাপাশি সন্দ্বীপের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ক্রস ড্যামের মাধ্যমে সন্দ্বীপের সাথে মূল ভূখণ্ডের সংযোগ, নিয়মিত ফেরি সার্ভিস, একটি স্থায়ী টার্মিনাল নির্মাণ, চিকিৎসাব্যবস্থাকে স্থানীয়ভাবে শক্তিশালী করা এবং বিসিক শিল্পনগরী বাস্তবায়ন। এসব কার্যকরভাবে সম্পন্ন করা গেলে সন্দ্বীপ হতে পারে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক হাব।

আরও পড়ুন

Lading . . .