চার্জশিটেই বাদ গুলিবর্ষণকারী প্রবাসীরাও আসামি!
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট, ২০২৫

চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার অভিযোগে দায়ের করা হত্যা মামলার প্রথম চার্জশিটেই বড় ধরনের গলদ লক্ষ করা গেছে। এতে গুলিবর্ষণকারী আসামিকে বাদ দিয়ে প্রবাসী অনেককেই আসামি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার এজাহারে সুনির্দিষ্ট আসামি ছিল ৮ জন। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছিল ৩০-৪০ জনকে। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনার সঙ্গে জড়িত হিসাবে তদন্তে পেয়েছেন ২৩১ জনের নাম! এই ২৩১ জনের বিরুদ্ধেই আদালতে অভিযোগপত্র বা চার্জশিট দিয়েছেন। আগামী ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বাদীর উপস্থিতিতে অভিযোগপত্র গ্রহণের ওপর শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলায় শহীদুল ইসলাম শহীদ (৩৭) নামে এক দোকান কর্মচারী হত্যা মামলায় চান্দগাঁও থানার এসআই মো. ফয়সাল চার্জশিট দাখিল করেন। চট্টগ্রাম মহানগরীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনায় যে ১৪টি হত্যা মামলা করা হয়েছে, তার মধ্যে এটিই ছিল প্রথম চার্জশিট।
চার্জশিটে চট্টগ্রামের সাবেক তিন মন্ত্রী, দুই মেয়র, সাবেক বেশ কয়েকজন এমপি, নগরীর ৪১ ওয়ার্ডের মধ্যে বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনার সময় দেশে ছিলেন না-এমন তিন প্রবাসীকেও আসামি করা হয়েছে। আবার পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা না পাওয়ার অজুহাতে চার্জশিটে থাকা একজনের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। জাফর নামের ওই আসামি ভিকটিমের ওপর গুলিবর্ষণ করেছেন বলে এজাহারে উল্লেখ ছিল। দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ১৬ দিনের মাথায় এই মামলার তৃতীয় আইও ফয়সাল এই মামলার চার্জশিট দেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বাদী নাম দিয়েছেন জ্ঞাত-অজ্ঞাত মিলে ৪৮ জনের। আর তদন্তকারী কর্মকর্তা পেয়েছেন ২৩১ জনের নাম। তিনি কী আদৌ এই মামলা তদন্ত করেছেন নাকি কারও বশীভূত হয়ে বা হয়রানির উদ্দেশ্যে এখানে ‘চার্জশিট বাণিজ্য’ করেছেন, সেটিই বড় প্রশ্ন। যেখানে শুরু থেকেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা থেকে সরকারে ঊর্ধ্বতন মহল নিরীহ বা জড়িত নয় এমন লোকজনকে হয়রানি না করতে নির্দেশ দিয়ে আসছে, সেখানে এই মামলার চার্জশিট থেকে প্রতীয়মান হয়ে যে, কেবল হয়রানির উদ্দেশ্যেই গণহারে এখানে মামলার আসামি করা হয়েছে। মামলার আইও এখানে পেশাদারিত্বের পরিচয় দেননি। এ ধরনের মামলার বিচারে আদালতও হয়রানির শিকার ও বিব্রত হবেন বলে আমার ধারণা। এতে প্রকৃত আসামিরা পার পেয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
চান্দগাঁও থানার এসআই ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. ফয়সাল বলেন, আগের দুই আইও তদন্ত কাজ প্রায় শেষ করেছিলেন। তিনি এসে ফিনিশিং দিয়েছেন কেবল। ঘটনার সময় দেশের বাইরে থাকা লোকজনকে আসামি করা, গুলিবর্ষণকারী আসামিকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইও বলেন, এটা রাষ্ট্রীয় মামলা। তিনি বিস্তারিত কিছু বলতে পারবেন না। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরার্মশ দেন তিনি।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার যুগান্তরকে বলেন, মামলার এজাহারে কত জনের নাম ছিল, সেটা বড় কথা নয়। তদন্তে পাওয়া গেলে যত সংখ্যক আসামিই হোক না কেন তাতে কোনো সমস্যা নেই। তবে হয়রানিমূলক মামলা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও হয়েছে। এসব প্রমাণ করা যায়নি। আসামি বেশি হওয়ায় এই মামলাও প্রমাণ করা কঠিন হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সিএমপি সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও হতাহতের ঘটনায় নগরীর ১৬ থানার মধ্যে ৮টি থানায় ৬৩টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা রয়েছে ১৪টি। এসব মামলায় এজাহারনামীয় আসামি রয়েছে ৬ হাজার ৬৯৪ জন। আর অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে ১৩ হাজার ৫৯০ জন। গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত ১৪৬ জন এজাহারনামীয় আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আর তদন্তে প্রাপ্ত আসামি গ্রেফতার হয়েছে ৮৩৭ জন। সব মামলাতেই নিরপরাধ ব্যক্তিকে পারিবারিক ও রাজনৈতিক আক্রোশের কারণে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে শুরু থেকেই।
ভুক্তভোগী একাধিক আসামি অভিযোগ করেছেন, এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নুরুল হাকিমসহ একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা চার্জশিটে ঢোকানো বা চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেওয়ার নামে বড় ধরনের বাণিজ্য করেছেন। এ বিষয়ে তারা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
আরও পড়ুন