প্রকাশ: ৯ আগস্ট, ২০২৫

কুমিল্লায় গুঙ্গাইজুড়ি খাল দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে কেমিক্যালযুক্ত বিষাক্ত পানি। দূষিত এসব পানি গিয়ে পতিত হচ্ছে ডাকাতিয়া নদীতে। দক্ষিণ কুমিল্লার ওপর দিয়ে প্রবাহিত এ দুটি জলধারার পানি বিষাক্ত হওয়ায় ওই এলাকার লাখ লাখ কৃষক এবং সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তাছাড়া পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এতে দক্ষিণের অর্ধশতাধিক গ্রামের বাসিন্দা নানা রোগবালাইয়ে ভুগছে। এদিকে বর্জ্যযুক্ত বিষাক্ত পানি নিয়ে চলছে পরস্পরবিরোধী দোষারোপ। অপরদিকে বিষাক্ত পানির উৎস পরীক্ষায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ টিম নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুমিল্লার সদর দক্ষিণের গুঙ্গাইজুড়ি খাল শুরু হয়েছে আদর্শ সদর উপজেলার কটকবাজার এলাকা থেকে। এটি মূলত গোমতী নদীর একটি শাখা। সদর দক্ষিণ উপজেলার টঙ্গীরপাড় এলাকা পর্যন্ত খালটি বিস্তৃত। খালটি সোনাইছড়ি সেচ প্রকল্পের অংশ, যা ১৯৬৩ সালে ড. আখতার হামিদ খান শুরু করেছিলেন। এটি কুমিল্লার পূর্ব দক্ষিণাঞ্চলে সেচব্যবস্থা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এদিকে ডাকাতিয়া নদী শুরু হয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড় থেকে। এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে কুমিল্লার বাগমারা দিয়ে এবং পরে চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। নদীটি কুমিল্লা-লাকসাম-চাঁদপুর হয়ে মেঘনা নদীতে মিশেছে। ডাকাতিয়া নদী মেঘনা নদীর একটি উপনদী। গুঙ্গাইজুড়ি খালের পানি ডাকাতিয়া নদীতে গিয়ে একাকার হয়।
এই ডাকাতিয়া নদী এবং গুঙ্গাইজুড়ি খাল দক্ষিণ কুমিল্লার লাখ লাখ মানুষের পানির উৎস বলা হয়। কিন্তু কলকারখানার বর্জ্যে এ দুটি জলধারার পানি এখন বিষাক্ত হয়ে গেছে। এতে নগরীর ইপিজেড এলাকা থেকে সদর দক্ষিণের লালমাই বাগমারা পর্যন্ত আশপাশের সবকটি গ্রামের মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার।
বিশেষ করে গুঙ্গাইজুড়ি খালের বিষাক্ত বর্জ্যে সদর দক্ষিণের রাজাপাড়া, দিশাবন্দ, লক্ষ্মীনগর, কাজীপাড়া ও উনাইসার হীরাপুর, মোস্তফাপুর, দক্ষিণ রামপুর, বিজয়পুর জেলখানাবাড়ী, লালমাই, চণ্ডীপুর এলাকার হাজার হাজার কৃষক এবং সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
ডাকাতিয়া নদী এবং গুঙ্গাইজুড়ি খালে বিষাক্ত পানির উৎস নিয়ে চলছে পরস্পরবিরোধী দোষারোপ। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন বলছে, এসব বর্জ্য এবং বিষাক্ত পানি ইপিজেডের কলকারখানা থেকে বের হতে পারে। কিন্তু ইপিজেড কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের বর্জ্য শোধনাগারে পানি শোধন করা হচ্ছে। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় এ পালটাপালটি দোষারোপ অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি ডাকাতিয়া নদী এবং গুঙ্গাইজুড়ি খালে বিষাক্ত পানির উৎস শনাক্ত করতে বিশেষজ্ঞ টিম নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন। সম্প্রতি দক্ষিণ কুমিল্লার গণমানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে ফেস দ্য পিপলের সম্পাদক সাইফুর রহমান সাগর জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় জেলা প্রশাসক বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দেন। এক মাসের মধ্যে গুঙ্গাইজুড়ি খালের বিষাক্ত পানির উৎস শনাক্ত এবং সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার।
দিশাবন্দ এলাকার বাসিন্দা মোজাম্মেল হক বলেন, ইপিজেড করার আগে পানিতে এমন দুর্গন্ধ ছিল না। এসব বিষাক্ত পানি ইপিজেডের ভেতর থেকেই বের হচ্ছে। খাল থেকে ঘরের ভেতরেও যাচ্ছে দুর্গন্ধ। এমন দাবি পাশের লক্ষ্মীনগর, কাজীপাড়া ও উনাইসার গ্রামের বাসিন্দাদেরও।
জানা যায়, কুমিল্লা ইপিজেডে দেশি-বিদেশি ৪৮টি কারখানা রয়েছে। স্থানীয়দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইপিজেডের দক্ষিণপ্রান্তে তরল বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) স্থাপন কাজ শুরু হয়। ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়। প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পরিশোধন করতে পারে শোধনাগারটি। এরপরও বিষাক্ত তরল বর্জ্যে পরিবেশ দূষণ রোধে ইপিজেড কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ সন্তোষজনক নয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
সাম্প্রতিক সময়ে মোস্তফাপুর, দিশাবন্দ, রাজাপাড়া, লক্ষ্মীনগর ও কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইপিজেড প্রতিষ্ঠার আগে নগরীর খালে এমন কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি দেখেননি তারা। উনাইসার এলাকায় ইপিজেডের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সীমানা প্রাচীরের নিচ দিয়ে বের হচ্ছে এসব বিষাক্ত পানি। এরপর পাশের দিশাবন্দ ও কাজীপাড়া খাল হয়ে এসব বিষাক্ত পানি মোস্তফাপুরে গিয়ে গুঙ্গাইজুড়ি খালে পড়ছে। এরপর সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর এলাকা হয়ে লালমাই উপজেলার বাগমারা এলাকায় গিয়ে ডাকাতিয়া নদীতে মিশছে। এসব এলাকার খালবিল ও নালার পানিও গাঢ় কালো রঙের দুর্গন্ধযুক্ত।
কাজীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মীর হোসেন বলেন, পানির সঙ্গে আসা দুর্গন্ধে বাড়িতে থাকা যায় না। বিষাক্ত গ্যাসের কারণে বাসার ফ্রিজ ও মসজিদের এসিও নষ্ট হয়ে গেছে।
ইপিজেড কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের মাধ্যমে সব বর্জ্য পরিশোধন হচ্ছে। তাদের কোনো ধরনের বর্জ্য খাল ও জলাশয়ে মিশছে না। একই খালে সিটি করপোরেশনের পানি প্রবাহিত হয়। সেই পানিই বিষাক্ত।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, নগরের ড্রেনের পানি এত বিষাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত নয়। কারণ, নগরীর পানি আরও একাধিক পয়েন্ট দিয়ে বের হয়। সেখান থেকে তো এত অভিযোগ আসছে না। তবুও নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি উন্নত প্রযুক্তির প্রকল্প চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, ইপিজেড এলাকা থেকে হঠাৎ ড্রেন সরিয়ে নিতে গেলে নগরীর পানি প্রবাহে বড় ধরনের সমস্যা হবে।
বেপজা কুমিল্লার নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহবুব জানান, কেন্দ্রীয় তরল বর্জ্য শোধনাগার ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে। ইপিজেডের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সব ধরনের তরল বর্জ্য শোধনাগারে পরিশোধন করা হচ্ছে।
ফেস দ্য পিপলের সম্পাদক এবং গুঙ্গাইজুড়ি খালের বিষাক্ত পানি নিয়ে আন্দোলনের মাস্টার মাইন্ড সাইফুর রহমান সাগর বলেন, গুঙ্গাইজুড়ি খাল এবং ডাকাতিয়া নদী দক্ষিণ কুমিল্লার প্রাণ। এ দুটি জলধারার পানি দূষণমুক্ত করতে না পারলে পরিবেশ, প্রকৃতি, জনজীবন এবং কৃষি-সবই বিধ্বস্ত হয়ে যাবে। এ দুটি জলধারা রক্ষা করা দক্ষিণ কুমিল্লার লাখো মানুষের প্রাণের দাবি।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার বলেন, আমরা দুটি এলাকার পানি সংগ্রহ করে ল্যাবে টেস্ট করে দেখব। এই বিষাক্ত পানির উৎস শনাক্ত করতে প্রয়োজনে বুয়েট কিংবা অন্যান্য পানি বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া হবে। আমরা দুটি পক্ষকেই না জানিয়ে পানির স্যাম্পল কালেকশন করব।