Advertisement

ঝাড়ফুঁক করতে এসে মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা, দেখে ফেলায় মা–মেয়েকে হত্যা

প্রথম আলো

প্রকাশ: ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও তাঁর মায়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খানের সংবাদ সম্মেলন। মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে পুলিশ সুপার কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও তাঁর মায়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খানের সংবাদ সম্মেলন। মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে পুলিশ সুপার কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ও তাঁর মায়ের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় মো. মোবারক হোসেন (২৯) নামের এক কবিরাজকে গ্রেপ্তারের পর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটনের দাবি করেছে পুলিশ।

পুলিশের দাবি, ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাড়া বাসায় ওই কবিরাজের যাতায়াত ছিল। ঝাড়ফুঁক করার সময় তিনি ওই ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালান। মা ওই দৃশ্য দেখে ফেলায় প্রথমে তাঁকে বালিশচাপা দিয়ে এবং পরে মেয়েকে গলা টিপে হত্যা করা হয়।

আজ মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান এ কথা বলেন।

গ্রেপ্তার মোবারক হোসেনের বাড়ি জেলার দেবীদ্বার উপজেলার কাবিলপুর গ্রামে। তিনি কুমিল্লা নগরের বাগিচাগাঁও কাজীবাড়ি এলাকায় ভাড়া থাকেন। ঢাকায় পালিয়ে যাওয়ার সময় গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় কুমিল্লা রেলস্টেশন এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

এর আগে গতকাল সকাল সাতটার দিকে নগরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কালিয়াজুরি এলাকার পিটিআই মাঠ–সংলগ্ন একটি ভবনের দ্বিতীয় তলার ভাড়া বাসা থেকে মা ও মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত শিক্ষার্থী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১–২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁদের বাড়ি কুমিল্লা নগরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে। এ ঘটনায় গতকাল বিকেলে নিহত ছাত্রীর বড় ভাই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় মোবারক হোসেনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাঁকে আদালতে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

পুলিশ সুপার জানান, ঘটনার পর ওই ভবনটির নিচতলায় থাকা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে মাথায় টুপি ও পাঞ্জাবি–পায়জামা পরা এক ব্যক্তিকে ওই বাসায় সন্দেহজনক যাতায়াত করতে দেখা যায়। তাঁকে একাধিকবার আসা–যাওয়া করতে দেখা গেছে। ওই ব্যক্তিই কবিরাজ মোবারক হোসেন। ভিডিওতে তাঁর সঙ্গে যা যা দেখা গেছে, সবকিছুই উদ্ধার করা হয়েছে। মা ও মেয়েকে হত্যার পর ওই বাসা থেকে চারটি মুঠোফোন, একটি ল্যাপটপ, মুঠোফোন ও ল্যাপটপের চার্জার নিয়ে গিয়েছিলেন মোবারক। তাঁর কাছ থেকে সেগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই বাসায় কমলা রঙের যে ব্যাগটি নিয়ে আসামি প্রবেশ করেন, সেটিও ওই বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

গ্রেপ্তার মোবারক হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান বলেন, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর পরিবারের ধারণা, তাঁকে (শিক্ষার্থী) জিন আসর করেছে। এ জন্য ঝাড়ফুঁক করানোর জন্য মেয়েকে নিয়ে স্থানীয় মাদ্রাসার এক শিক্ষকের কাছে যেতেন মা। সেখানে আসামি মোবারকের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় হয়। ওই শিক্ষার্থীর মা তখন মোবারককে তাঁর বাসায় গিয়ে ঝাড়ফুঁক করতে বলেন। সেই সুবাদে এক মাসের বেশি সময় ধরে মোবারক ওই বাসায় গিয়ে ঝাড়ফুঁক দিয়ে আসছেন।

মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান বলেন, ঘটনার দিন রোববার সকাল সাড়ে আটটায় মোবারক একটি কমলা রঙের শপিং ব্যাগ ও একটি কালো রঙের ব্যাগ নিয়ে ভুক্তভোগীদের বাসায় ঢোকেন। ওই শিক্ষার্থীকে ঝাড়ফুঁক করে বাসায় পানি ছিটিয়ে দেন। বেলা ১১টা ২৩ মিনিটে বাসা থেকে বের হয়ে বেলা ১১টা ৩৪ মিনিটে আবার ওই বাসায় ঢোকেন। ফিরে এসে দেখেন ভুক্তভোগী ছাত্রী তাঁর কক্ষে শুয়ে আছেন। তখন তাঁকে ধর্ষণের চেষ্টা চালান মোবারক। এ সময় শিক্ষার্থীর মা এই দৃশ্য দেখে ফেলেন। তিনি আসামিকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে মোবারকের সঙ্গে তাঁর ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে মোবারক বালিশচাপা দিয়ে তাঁকে হত্যা করেন। এরপর ওই ছাত্রীর কক্ষে ঢুকে আবার ধর্ষণের চেষ্টা করলে তিনি বাধা দিলে তাঁর গলা চেপে হত্যা করা হয়। মা ও মেয়েকে হত্যার পর চারটি মুঠোফোন ও একটি ল্যাপটপ নিয়ে পালিয়ে যান মোবারক।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেপ্তার এড়াতে অবস্থান পরিবর্তন করে আত্মগোপনে ছিলেন মোবারক। তবে তথ্যপ্রযুক্তি ও পুলিশের কৌশলে দ্রুত সময়ের মধ্যে তাঁকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি পুরো ঘটনার বিস্তারিত জানিয়েছেন। তিনি আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হয়েছেন।

ঘটনার পর গতকাল দুপুরে জেলার নাঙ্গলকোট থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে আবদুর রব (৭৩) নামের এক ব্যক্তিকে আটক করে র‌্যাব। আবদুর রবও একজন কবিরাজ। আটকের পর র‌্যাব জানায়, নিহত ছাত্রীর মা হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগে সর্বশেষ তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। এ ছাড়া আবদুর রবও দীর্ঘদিন ওই বাসায় যাতায়াত করতেন। তবে মোবারককে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ বলছে, প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সঙ্গে আবদুর রবের কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।

র‌্যাব–১১ সিপিসি–২ কুমিল্লা কোম্পানির অধিনায়ক মেজর সাদমান ইবনে আলম প্রথম আলোকে বলেন, সন্দেহভাজন হিসেবে ওই ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছিল। তিনি নিজেও কবিরাজ হওয়ায় তাঁর কাছ থেকে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসে। যেগুলো মূল হত্যাকারীকে শনাক্তে কাজে লেগেছে। তাঁরা তাঁকে কোতোয়ালি থানায় হস্তান্তর করেছেন।

কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সঙ্গে আবদুর রবের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে আজ দুপুর ১২টা থেকে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাঁরা অভিযোগ করেন, ঘটনার নেপথ্যের কারণ জানাতে গড়িমসি করছে পুলিশ। পরে বেলা তিনটার দিকে পুলিশ সুপার এসে আসামি গ্রেপ্তারসহ পুরো হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের বিস্তারিত তুলে ধরেন। এরপর শিক্ষার্থীরা নিহত ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে কি না নিশ্চিত করতে পুলিশকে আহ্বান জানিয়ে তাঁদের কর্মসূচি শেষ করেন।

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান বলেন, ‘মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন কি না, আমরা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হতে পারিনি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ও ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া যাবে।’

Lading . . .