প্রকাশ: ৯ আগস্ট, ২০২৫

লক্ষ্মীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলায় চার শিক্ষার্থী এবং গণপিটুনিতে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের ৮ কর্মীসহ মোট ১২ জন নিহত হয়েছেন। আড়াইশ গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন তিনশ’র বেশি মানুষ। এসব ঘটনায় একাধিক মামলায় এখন পর্যন্ত ২০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে ১২০ জনকে। এছাড়া হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার ভিডিও চিত্র দেখে আরও ১১৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় সাংবাদিক এবং আন্দোলনের ভিডিও ফুটেজ থেকে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সকালে লক্ষ্মীপুর শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে বাগবাড়ি কৃষি কার্যালয়ের সামনে আন্দোলনকারীরা জড়ো হতে চেষ্টা করে। এসময় কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মাহমুদ, জুয়েল, যুবলীগের ইমন ও রায়হানসহ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের প্রায় ৩০ জন অস্ত্রধারী নেতাকর্মী আন্দোলনরত কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ধরে বেদম মারধর করে। হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র-জনতা বাগবাড়িতে একত্রিত হয়ে মিছিল বের করে। পরে আন্দোলনকারীরা ঝুমুর সিনেমা হল এলাকায় অবস্থান নেয়।
সকাল ১০টার সময় হঠাৎ লাঠিসোঁটা ও অস্ত্রসহ উত্তর তেমুহনী থেকে মিছিল নিয়ে ঝুমুরের দিকে অগ্রসর হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মিছিলটি বাগবাড়িতে পৌঁছালে আওয়ামী লীগের হামলায় কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়। এসময় বেশ কয়েকটি ককটেল ফাটিয়ে এলাকায় চরম আতঙ্ক ও ত্রাস সৃষ্টি করে মিছিলকারীরা। হামলার খবর পেয়ে ঝুমুর এলাকা থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বাগবাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। মিছিলটি মাদাম ব্রিজের পূর্বপ্রান্তে পৌঁছলে টিপু, বায়েজিদ ভূইয়া ও হেলমেট পরা কয়েকজন সন্ত্রাসী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। এসময় ব্রিজের ওপর প্রথম গুলিবিদ্ধ হয়ে কলেজ শিক্ষার্থী সাদ আল আফনান ঘটনাস্থলে নিহত হন। আহত হয় প্রায় অর্ধশতাধিক।
আফনানের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজারো ছাত্র-জনতা জড়ো হয়ে আওয়ামী বাহিনীকে ধাওয়া করে। এভাবে চলতে থাকে একের পর এক ধাওয়া-পালটা ধাওয়া। আর পিছু হটতে থাকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে রাস্তা ছেড়ে টিপু ও তার লোকজন তমিজ মার্কেট, তার বাসা ও ছাদে অবস্থান নেয়। শিক্ষার্থীরা উত্তর তেমুহনী ও দক্ষিণ দিক থেকে দুভাগে বিভক্ত হয়ে টিপুর বাসার দিকে অগ্রসর হয়।
এসময় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিন টিপু ও তার অনুসারী নেতা-কর্মীরা বাসার ছাদ থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে শিক্ষার্থীদের ওপর। টিপুর আরেকটি গ্রুপ নিচে শাঁখারিপাড়া মোড় ও তিতা খাঁ মসজিদ এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর কয়েক দফা হামলা করে। এখানে দীর্ঘক্ষণ চলে ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও ককেটল বিস্ফোরণ। টিপুর গুলিতে তিন আন্দোলনকারী নিহত হন। তারা হলেন সাবির হোসেন, কাউছার হোসেন বিজয় ও ওসমান গনি। এ নিয়ে ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চার শিক্ষার্থী নিহত হন। আড়াইশ গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় তিনশ’র বেশি মানুষ। এর প্রতিবাদে টিপুর বাসভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে আন্দোলনকারীরা। এদিন বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে গণপিটুনিতে টিপুর অনুসারী ৮ কর্মী নিহত হয়। অবরুদ্ধ অবস্থায় আটকা পড়ে টিপুর বাসার ভেতরে ২৮ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গভীর রাতে তাদের উদ্ধার করে নিরাপদে পৌঁছে দেয় ।
জেলা সদর থানা সূত্রে জানা যায়, ছাত্র সাদ আল আফনান হত্যার ঘটনায় নাছিমা আক্তার বাদী হয়ে, টিপু ও মাসুম ভূইয়াসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ৬০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে সদর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এই মামলায় গ্রেফতার করা হয় ৪৬ জনকে। এর মধ্যে ৩০ জনকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার ভিডিও চিত্রে আরও ১০০ জনকে চিহ্নিত করা হয়।
অপরদিকে ছাত্র সাব্বির হোসেন হত্যার ঘটনায় পৃথক আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় ৯১ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলায় গ্রেফতার করা হয় ৮৩ জনকে। ৭৫ জনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। শনাক্ত করা হয় আরও ১০২ জনকে।
গুলিবিদ্ধ আহত আবদুল মতিন আরও একটি মামলা করেন। ওই মামলায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি গোলাম ফারুক পিংকুসহ ৭৬ জনের নাম উল্লেখ করে আরও দেড়শ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। এই মামলায় ২২ জন গ্রেফতার হয়েছে। এছাড়া গুলিবিদ্ধ আল সবুজ আরও একটি মামলা করেছেন। সবুজের মামলায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়নসহ ১৬২ জন ও অজ্ঞাত ৩০০ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলায় ৪৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
অপরদিকে পুলিশের পক্ষ থেকেও আরও একটি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন ইউনিটের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ ১৮৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
নিহত সাদ আল আফনানের মা নাছিমা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, একমাত্র ছেলেকে হারিয়েছি। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন চাপে নিজের ঘরে ঘুমাতে পারছি না। হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই এবং বিচার চাই।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার এসআই মোবারক হোসেন ও ফজলুল করিম জানান, ইতোমধ্যে চার আগস্টের দায়ের করা মামলায় ২০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১২০ জনকে রিমান্ডে আনা হয়। পাশাপাশি ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার ভিডিও চিত্রে আরও ১১৩ জনকে শনাক্ত করা হয়। এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে জব্দকৃত আলামত ফরেনসিক রিপোর্টে সত্যতা মিলেছে। আসামিদের গ্রেফতারের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
পুলিশ সুপার মো. আকতার হোসেন বলেন, জুলাই আন্দোলনে চার শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় পুলিশ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। ইতোমধ্যে ২০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দ্রুত এসব মামলার প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন