Advertisement

ফজলে করিমের দাপটে পুকুর ভরাট করে বিপণিকেন্দ্র, ১৫ বছর পর মামলা

প্রথম আলো

প্রকাশ: ৯ আগস্ট, ২০২৫

শত বছরের পুকুর ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে পাঁচতলা বাণিজ্যিক ভবন। গত বুধবার বিকেলে চট্টগ্রামের রাউজানের পাহাড়তলী ইউনিয়নের চৌমুহনী বাজারেছবি: এস এম ইউসুফ উদ্দিন
শত বছরের পুকুর ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে পাঁচতলা বাণিজ্যিক ভবন। গত বুধবার বিকেলে চট্টগ্রামের রাউজানের পাহাড়তলী ইউনিয়নের চৌমুহনী বাজারেছবি: এস এম ইউসুফ উদ্দিন

শত বছরের পুরোনো জলাধার। নাম পাহাড়তলী জামে মসজিদ পুকুর। পুকুরটির আয়তন পাড়সহ প্রায় সোয়া এক একর। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই প্রধান সড়কের পাশে রাউজানের পাহাড়তলী এলাকায় ছিল পুকুরটির অবস্থান। ১৫ বছর আগে পুকুরটি ভরাট করা হয় আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর ক্ষমতার দাপটে। ভরাটকাজ তদারকি করেন পাহাড়তলী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা রোকন উদ্দীন।

পুকুরটি ভরাট করে গড়ে উঠেছে বহুতল বিপণিকেন্দ্র, আবাসন, খেলার কৃত্রিম টার্ফ ও ভাড়া ঘর। বিপণিকেন্দ্রের নাম ডিএন প্লাজা। পুকুরটি বাঁচাতে লাগোয়া পাহাড়তলী চৌমুহনী জামে মসজিদের মোতোয়ালি এ কে এম আকতার কামাল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। এতে মাসখানেক বন্ধ ছিল ভরাটকাজ। কিন্তু ফজলে করিম চৌধুরীর দাপটে পুনরায় ভরাটকাজ শুরু হয়। এরপর পুকুর ভরাট করে পরিবর্তন করা হয় জমির শ্রেণিও।

সাহারা খাতুনের কাছে যাওয়া এবং জলাশয় ভরাট বন্ধের চেষ্টার পরিণতিও ভোগ করতে হয়েছিল মোতোয়ালি আকতার কামাল চৌধুরীকে। তাঁর অভিযোগ, ফজলে করিম চৌধুরী ফোনে হুমকি দিয়েছিলেন। এ ছাড়া তাঁর ব্যক্তিগত দোকান দখল করে পাহাড়তলী আওয়ামী লীগের কার্যালয় করা হয়েছে।

নির্দেশনা থাকলেও পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে দেড় দশক ধরে মামলার সাহসই করতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফজলে করিম গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে। ভরাটে অভিযুক্তরাও পলাতক। অবশেষে চলতি বছরের ৪ আগস্ট মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এতে রোকন উদ্দীনসহ তিনজনকে আসামি করা হয়। ফজলে করিমের বিরুদ্ধে করা হয় সাধারণ ডায়েরি।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাউজানে সংসদ সদস্য ফজলে করিমের একচ্ছত্র আধিপত্য শুরু হয়। তাঁর এবং অনুসারী নেতা কিংবা ইউপি চেয়ারম্যানদের দাপট শুরু হয় বিভিন্ন ইউনিয়নে। পাহাড়তলী ইউপিতে তখন চেয়ারম্যান ছিলেন ফজলে করিমের অনুগত মো. ইব্রাহিম চৌধুরী।

ইব্রাহিম চৌধুরীর মৃত্যুর পর ২০১৩ সাল থেকে তাঁর ছেলে রোকন উদ্দীন সংসদ সদস্যের মনোনীত চেয়ারম্যান হন ওই ইউনিয়নে। বর্তমানে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক। ২০১০ সাল থেকে রোকন মসজিদের সামনের জলাধারটি ভরাট শুরু করেন বলে অভিযোগ।

২০১১ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরে দেওয়া পুকুর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার অভিযুক্তরা প্রতিপালন করেননি। এ কারণে ২০১১ সালের ৩১ মার্চ তাঁদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে থানায় মামলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ফজলে করিমের ভয়ে এত দিন পরিবেশ অধিদপ্তর ওই মামলা করতে পারেনি। বরং জলাধারের নথিগুলোও অধিদপ্তর থেকে গায়েব হয়ে যায়।

পাহাড়তলী ঊনসত্তরপাড়া মৌজার ২১৩১ নম্বর খতিয়ানের বিএস দাগ ৬২৫০ অনুযায়ী জলাধারটির আয়তন ১২২ শতক। মসজিদের মোতোয়ালি আকতার কামাল চৌধুরী বলেন, ‘পুকুরটির ২৭ শতাংশ জমি সড়ক ও জনপদ বিভাগ থেকে মসজিদের নামে ইজারা নেওয়া। আরও ৭ শতাংশ জমি মসজিদের নিজস্ব। বাকিগুলো ছাবের আহম্মদ তালুকদার ও মফিজুর রহমানের নামে। ৪ শতাংশ ছাড়া আর কোনো জমি এখন মসজিদের নেই। পুকুর ভরাট করে পুরোটাতে মার্কেট করে ফেলেছে।’

ছাবের আহম্মদ তালুকদার ও মফিজুর রহমান তালুকদার রোকন উদ্দীনের মামা। সেই সুবাদে ক্ষমতার দাপটে জলাধারটি ভরাটের দায়িত্ব পান রোকন উদ্দীন।

অভিযোগ জমা পড়ার পর ২০১০ সালের ৬ জুন পরিবেশ অধিদপ্তর নোটিশ দিয়েও ভরাটকাজ বন্ধ করতে পারেনি। পরে ২০১১ সালের ৫ মার্চ ঢাকায় তাঁদের বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট মামলা হয়। অধিদপ্তরের তখনকার পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুকুর ভরাটের জায়গাটি পরিদর্শন করেছিলেন। এরপর ২০১১ সালের ৯ মার্চ শুনানি করে পুকুর ভরাটের জন্য তাঁদের ২ লাখ ৩০ হাজার ৫৮০ টাকা জরিমানা করেছিলেন। পাশাপাশি পাঁচ বিবাদী অধিদপ্তরে অঙ্গীকারনামা দেন যে ভরাটকৃত পুকুর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু পরে সেখানে বহুতল ভবন ওঠে।

আকতার কামাল ভরাটকাজ বন্ধ করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে ঘুরেছিলেন বিষয়টি ফজলে করিমের কানে গেলে তিনি ক্ষিপ্ত হন।

আকতার কামাল তখন মেঘনা পেট্রোলিয়াম চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। আকতার কামাল বলেন, ‘২০২০ সালে এসে আমাদের চারটা দোকান দখল করে ১০ শতক জমির ওপর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় বলে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়। পটপরিবর্তনের পর ওই দখলকৃত দোকান ও জমি পুনরুদ্ধার করি। দুটি জিডিও করি আগের ঘটনা উল্লেখ করে।’

পরিবেশের অনেক বিষয়ে ক্ষতি হয়েছে দুর্বৃত্তায়নের কারণে। আর স্বৈরাচারী শাসনামলে সেই দুর্বৃত্তায়ন সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। একজন প্রণেতা আইন ভেঙে পুকুর ভরাট করে ফেলেন। তাঁর বিরুদ্ধে আবার মামলা করা যায় না, এটা আইনের শাসনের জন্য ঝুঁকি। এখন মামলাটা শুরু হয়েছে, সেটা আশার কথা। পরিবেশ অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেব।
—সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।

আকতার কামাল জিডিতে সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে করিমের প্রত্যক্ষ মদদে পুকুর ভরাট এবং তাঁর ও মসজিদের জায়গা দখলের অভিযোগ করেন। জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা রাউজান থানার উপপরিদর্শক মো. রেজাউল বলেন, নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন আকতার কামাল। পুকুরও ভরাট করা হয়। বিষয়গুলোর তদন্ত চলছে এখন।

অভিযুক্তরা এখন পলাতক রয়েছেন। এ বিষয়ে বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ডিএন প্লাজার তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমি দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছি। মার্কেটের দোকান ও বাসার ভাড়া তুলি। এর বাইরে কিছু জানি না।’

২০১১ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরে দেওয়া পুকুর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার অভিযুক্তরা প্রতিপালন করেননি। এ কারণে ২০১১ সালের ৩১ মার্চ তাঁদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে থানায় মামলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ফজলে করিমের ভয়ে এত দিন পরিবেশ অধিদপ্তর ওই মামলা করতে পারেনি। বরং জলাধারের নথিগুলোও অধিদপ্তর থেকে গায়েব হয়ে যায়।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার গবেষণা কর্মকর্তা মো. আশরাফ উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, অধিদপ্তর থেকে পাহাড়তলী মসজিদ পুকুর ভরাট–সংক্রান্ত নথি গায়েব হয়ে যায়। এগুলো আবার সংগ্রহ করা হয়।

মো. আশরাফ উদ্দীন আরও বলেন, ‘জমির শ্রেণি পুকুর পরিবর্তন করে ভিটে করেছিলেন তাঁরা। আমরা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবরে শ্রেণি আগেরটা ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন করেছি।’

সরেজমিন গত বুধবার বিকেলে পাহাড়তলী ইউনিয়নের চৌমুহনী বাজারের পাশে দেখা যায়, ডিএন প্লাজা নামের পাঁচতলার একটি বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনের সামনে খোলা জায়গা রয়েছে। ভবনের নিচতলায় দোকান পাট, দোতলায় হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, অফিস ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় থেকে পঞ্চম তলায় রয়েছে ফ্ল্যাট। ডিএন প্লাজার উত্তর পাশে করা হয়েছে একতলা আধাপাকা টিনশেডের বড় কলোনি।

এই কলোনির উত্তর পাশে রয়েছে একটি বড় কৃত্রিম খেলার টার্ফ। এর পাশে রয়েছে একটি বড় রেস্তোরাঁ। পুকুর ভরাট করে এসব করা হয়।

আকতার কামাল ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বরাবরে মসজিদের জায়গা উদ্ধার এবং পুকুর ভরাটের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানান। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবেশের অনেক বিষয়ে ক্ষতি হয়েছে দুর্বৃত্তায়নের কারণে। আর স্বৈরাচারী শাসনামলে সেই দুর্বৃত্তায়ন সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। একজন প্রণেতা আইন ভেঙে পুকুর ভরাট করে ফেলেন। তাঁর বিরুদ্ধে আবার মামলা করা যায় না, এটা আইনের শাসনের জন্য ঝুঁকি। এখন মামলাটা শুরু হয়েছে, সেটা আশার কথা। পরিবেশ অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেব।’

Lading . . .