প্রকাশ: ১৮ আগস্ট, ২০২৫

শিল্পঅধ্যুষিত গাজীপুর জেলায় জ্বালানি সংকট, ব্যাংকিং খাতের অসহযোগিতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্ডার না থাকা, কার্যাদেশ বাতিল, শ্রমিক আন্দোলনসহ বৈশ্বিক নানা সংকটে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক তৈরি পোশাক কারখানা। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন লাখো শ্রমিক। ফলে এই জেলায় বাড়ছে অপরাধের সংখ্যা।
কলকারখানা ও পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর জেলায় ছোট-বড় প্রায় ৫ হাজার কলকারখানা রয়েছে, যার মধ্যে দুই হাজার ১৭৬টি নিবন্ধিত কারখানা। এর মধ্যে পোশাক কারখানার সংখ্যা এক হাজার ১৫৪টি। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে গত ৩ আগস্ট পর্যন্ত গাজীপুরের ১০৬টি কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে স্ব স্ব কর্তৃপক্ষ। এতে বেকার হয়েছেন প্রায় ৮০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী।
কারখানা মালিক ও বিজিএমইএর নেতারা বলছেন, জ্বালানি সংকট নিরসন ও দ্রুত ব্যাংকের সহজ ঋণ সুবিধা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকোর ১৩টিসহ মাহমুদ জিন্স, ডার্ড কম্পোজিট, পলিকন লিমিটেড, টেক্সটিল ফ্যাশন, ক্লাসিক ফ্যাশন, লা-মুনি অ্যাপারেলস, টি আর জেড গার্মেন্টস, রোয়া ফ্যাশন্সসহ বিজিএমইএভুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠান। পুলিশ বলছে, বিপুল সংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে যাওয়ায় অনেকেই অপরাধে জড়িত হয়ে পড়েছেন।
গাজীপুর মহানগরের কোনাবাড়ী জরুন এলাকার কেয়া গ্রুপ। এই কারখানায় কাজ করতেন ১৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জেরে প্রতিষ্ঠানে প্রথম মন্দার ধাক্কা লাগে ২০২৩ সালে। এরপর রাজনৈতিক ও ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে কারখানাটির একের পর এক ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। ঋণ খেলাপির অভিযোগ এনে কারখানা মালিক আব্দুল খালেক পাঠানকে গ্রেপ্তার করা হয়। মালিকপক্ষের কোনো আবেদনেই সাড়া দেয়নি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এতে শ্রমিক মজুরি, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিলসহ কারখানা পরিচালনার ব্যয় নির্বাহে তীব্র সংকটে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। পরে ঘন ঘন শ্রমিকদের আন্দোলন, ভাঙচুরের ঘটনায় কারখানাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
কেয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক পাঠান বলেন, ‘সাউথ ইস্ট ব্যাংক আমার এক হাজার মিলিয়ন রিয়েলাইজ পেয়েছে কিন্তু তারা আমার ফরেন কারেন্সিতে ৬শ মিলিয়ন ঢুকাইছে এবং চারশ মিলিয়ন তারা ডিপোজিট করে নাই, যার জন্য একটি প্রবলেম। পূবালী ব্যাংক দুইশ মিলিয়ন রিয়েলাইজ হয়েছে, তারা ফরেন কারেন্সিতে কোনো ডিপোজিট করে নাই। ন্যাশনাল ব্যাংক ৫৮ মিলিয়ন এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৬ মিলিয়ন ডিপোজিট করে নাই। এই চারটি ব্যাংকে আমার ঋণ ২৬শ কোটি টাকা। তারা যদি ফরেন কারেন্সি ঢোকায়, তবে সমস্যা থাকে না। এছাড়া কারখানায় গ্যাস সংকট রয়েছে বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেকার এসব শ্রমিক অনেকে কাজ না পেয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। চাকরি ছেড়ে অটোরিকশা চালনা, ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনাসহ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন। অনেকে গাজীপুরে থেকে টেইলারিং, কাপড়ের দোকানসহ বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে গাজীপুরে শ্রমিকপল্লীতে চলছে হাহাকার। অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কারখানা বন্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন এলাকায়। কারখানা এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়ি ভাড়াসহ নানা ক্ষুদ্র পেশায় ধস নেমেছে।
স্টাইলিশ গার্মেন্টস চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি ব্যাংকের সহযোগিতা পাচ্ছে না মালিকরা। ফলে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে, বেকার হয়ে পড়েছে শ্রমিকরা। অনেকেই গ্রামে চলে গেছে। এটা অর্থনীতির জন্য খারাপ খবর। ব্যাংক সহায়তা, পোর্ট সুবিধাসহ এক্ষেত্রে সরকারের নীতি সহায়তা প্রয়োজন।’
এদিকে, তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ায় অনেক শ্রমিক চুরি-ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে গাজীপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে বলে মনে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এ ব্যাপারে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান বলেন, ৫ আগস্টের পর গাজীপুরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এখানকার শ্রমিক শ্রেণি যাদের পেটে ভাত বা খাবার জোগান করতে পারেনি, তারা রাস্তায় বেরিয়ে ছিনতাই বা অন্য অপরাধে জড়িয়ে যায়। কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেলে যে কোনো জায়গায় অপরাধ বেড়ে যায়, এটা স্বাভাবিক। কারখানা বন্ধ হওয়াটাকে আমরা হুমকি মনে করছি। ৫ আগস্টের পর বেকার শ্রমিকদের একটি অংশ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়েছে।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের সুপার আল মামুন শিকদার জানান, মালিকানা পরিবর্তন, ব্যাংকঋণ রিশিডিউল না করা, কাজ না থাকা ইত্যাদি কারণে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। তবে আর্থিক সংকটের কারণেই বন্ধ হচ্ছে বেশির ভাগ কারখানা।
আরও পড়ুন