গাজীপুরে বেপরোয়া অটোরিকশা, নেপথ্যে পুলিশের চাঁদাবাজি
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট, ২০২৫

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে গাজীপুরের মহাসড়কে উল্টো পথে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন চালকরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সামনে অহরহ এ ঘটনা ঘটলেও অনেকটা নির্বিকার পুলিশ। বেপরোয়া গতি ও অদক্ষ চালকের কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। অটোরিকশার এমন বেপরোয়া চলাচলের কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে দালাল চক্রের মাধ্যমে পুলিশের ম্যানেজের বিষয়। শুধু ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অন্তত ৪০০ অটোরিকশা থেকে চাঁদার মাধ্যমে মাসিক ৪০ লাখ টাকা যায় পুলিশের পকেটে। অন্যান্য মহাসড়ক মিলিয়ে এ চাঁদার পরিমাণ প্রায় অর্ধকোটি টাকা।
এ ছাড়া গত ৬ মাসের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শুধু গাজীপুর মহানগর এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৩টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে অটোরিকশা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। তবে পুলিশ বলছে, অবৈধ যান নিয়ন্ত্রণে তারা অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। চাঁদা আদায়ের অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অটোরিকশা নিয়ে উল্টো পথে বীরদর্পে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন চালক রাসেল। মহাসড়কে যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিষিদ্ধ, এ আইনও জানা আছে তার। কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা করেন না। আইন না মানলেও পুলিশ তাকে ধরে না, জব্দ করে না অটোরিকশা। কারণ, হাইওয়ে থানা পুলিশকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দেন রাসেল। শুধু রাসেল নয়, পুলিশের নিযুক্ত দালাল চক্রের মাধ্যমে প্রতি মাসে পুলিশকে টাকা দেন তার মতো অনেকেই।
১০ বছর ধরে মহাসড়কে অটোরিকশা চালান রাসেল। আগে তার গাড়ি পুলিশে ধরত, ডাম্পিংয়ে পাঠানো হতো। এ সমস্যা সমাধানের জন্য পুলিশের এক কনস্টেবল তার নিযুক্ত দালালকে পাঠান। প্রতিদিন ৩০০ করে টাকা দিলে আর রাসেলের অটোরিকশা ধরা হবে না বলে প্রস্তাব করে। রাজি হয়ে যান রাসেল। শুরু হয় তার মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়ানোর পালা। কিন্তু প্রতিদিন চাঁদা দেওয়ার পর সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। রাসেল বলেন, দিনে ৭০০-৮০০ টাকা উপার্জন করা সম্ভব হয়। এর মধ্যে আবার ৩০০ টাকা দিয়ে দিতে হচ্ছে পুলিশকে।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অটোরিকশা চালান আসাদ মিয়া। ৬ মাস ধরে এ মহাসড়কে অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।
তিনি বলেন, এই মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক সহকারী হিসেবে ভলান্টিয়াররা কাজ করেন। তাদের বিভিন্ন সময় ১০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ টাকা দিতে হয়। টাকা দিতে না চাইলে পুলিশ ডেকে এনে গাড়ি আটকে দেয়। কোনো গাড়ি আটক করলে ১২শ টাকার নিচে ছাড়ে না। গাড়ি ডাম্পিংয়ের ভয়ে চালকরা সেই টাকা দিয়ে গাড়ি ছাড়িয়ে আনেন। এই টাকার মধ্যে ২০০ টাকা ভলান্টিয়ার ও এক হাজার যায় পুলিশের পকেটে।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ব্যস্ততম মাওনা চৌরাস্তা এলাকাকে কেন্দ্র করে অন্তত ৪০০ অটোরিকশা অবৈধভাবে প্রতিদিন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি থেকে জৈনাবাজার পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মাওনা হাইওয়ে থানা পুলিশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না এসব অবৈধ যান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দালাল চক্রের মাধ্যমে পুলিশ প্রতি মাসে হাতিয়ে নিচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা। পুলিশের সামনে দিব্যি প্রতিদিন শত শত অটোরিকশা মহাসড়কে চলাচল করছে, অথচ কিছুই করছে না। তবে যে অটোচালক পুলিশকে টাকা দেয় না, সেটা জব্দ করে মামলা ঠুকে দেয়। এটাও আবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দেখানোর জন্য।
কয়েকজন অটোচালক জানান, পুলিশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ চালকদের হাতে এক ধরনের সংকেত দেওয়া থাকে। ওটা প্রদর্শন করলেই আর ধরে না। আর যাদের হাতে সংকেত নেই তাদের অটো ধরে নিয়ে যায়। রেকার বিল দিতে হয়, না হয় মামলা দেয়। এ ছাড়া ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয় অটোরিকশা।
স্থানীয়রা বলছেন, অটোরিকশার কারণে প্রতিদিনই মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। পঙ্গুত্ব বরণ করছেন কেউ কেউ। হাইওয়ে থানা পুলিশের চাঁদাবাজির কারণে মহাসড়কে বেপরোয়া হয়ে অটোরিকশা চালাতে সাহস পাচ্ছেন বলে জানান তারা। পুলিশ যদি কঠোর হতো, তাহলে একটি অটোরিকশাও উঠতে পারবে না। ৫ আগস্টের আগে মাওনা এলাকায় অটোরিকশার সংখ্যা ছিল ২০০। পটপরিবর্তনের পর গত এক বছরে অটোরিকশার সংখ্যা বেড়েছে আরও ২০০।
পুলিশের এক দালাল বলেন, অটোরিকশাপ্রতি ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, কয়েকজন দালালের কারণে আজ হাইওয়ে পুলিশ বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। হাইওয়ে থানার সব পুলিশ সদস্যই অর্থের লোভী নন। কিন্তু বেশিরভাগই অটো বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
মাওনা হাইওয়ে থানার ওসি আইয়ুব আলী বলেন, মহাসড়কের অবৈধ অটোরিকশা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। গত ৮ মাসে আমরা অবৈধ অটোরিকশার বিরুদ্ধে প্রায় হাজার মামলা দিয়েছি।
অটোরিকশা বাণিজ্যের সঙ্গে মাওনা হাইওয়ে থানা পুলিশের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, এসআই, এএসআই, কনস্টেবলসহ সব মিলিয়ে ৩৯ পুলিশ সদস্য মাওনা হাইওয়ে থানায় কর্মরত। মহাসড়কে অটোরিকশা যাতে না চলাচল করে, এজন্য মাইকিং করছি, নিয়মিত অভিযান চলছে ও মামলা হচ্ছে।
গাজীপুর হাইওয়ে রিজিয়নের পুলিশ সুপার ড. আ ক ম আক্তারুজ্জামান বসুনিয়া বলেন, অটোরিকশা মহাসড়কে একটি নিষিদ্ধ যানবাহন। এটা না চলার বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। তার পরও গাজীপুরে বিপুলসংখ্যক অটোরিকশা চলাচল করছে। এর পেছনে অবশ্যই সিন্ডিকেট রয়েছে। টাকা নিয়ে হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ একেবারেই অমূলক নয়। আমরা এটাকে হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করছি। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছি। পুলিশের সংশ্লিষ্টতা আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। যখন অভিযোগ আসছে তখনই আমরা সেটা প্রমাণের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিচ্ছি। অনিয়ন্ত্রিত এই অবৈধ যান নিয়ে সরকারের আদেশ থাকা প্রয়োজন।
পুলিশের চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক) এস এম আশরাফুল আলম বলেন, মহাসড়কে অটোরিকশার সংখ্যা বেড়ে গেছে। আমরা এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছি, ডাম্পিং ও মামলা হচ্ছে।
আরও পড়ুন