প্রকাশ: ৮ আগস্ট, ২০২৫

সেরাদের জন্য ফিফার পুরস্কার আছে, আছে উয়েফারও। কিন্তু ফুটবলে এখনো ব্যক্তিগত পর্যায়ে সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার মনে করা হয় ব্যালন ডি’অরকে। ১৯৫৬ সাল থেকে ফরাসি সাময়িকী ফ্রান্স ফুটবল এই পুরস্কার দিয়ে আসছে। এর পর থেকে গত সাত দশকে এই পুরস্কার নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, তবে এর আবেদন কমেনি একটুও। এখনকার ফুটবলে এত পুরস্কারের ভিড়েও তাই ব্যালন ডি’অর ফুটবলারদের কাছে সবচেয়ে বেশি কাঙ্ক্ষিত।
দুই ফরাসি ক্রীড়া সাংবাদিক—গ্যাব্রিয়েল আনো আর জ্যাক ফেরাঁর মাথায় প্রথমে বছরের সেরা ফুটবলারকে এ রকম একটা পুরস্কার দেওয়ার ভাবনা আসে। দুজনই ছিলেন লেকিপের সাংবাদিক। ফেঁরা আবার ফ্রান্স ফুটবল সাময়িকীর পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। শুধু ব্যালন ডি’অরই নয়, এখন যেটা চ্যাম্পিয়নস লিগ, যে টুর্নামেন্টের শুরুটা হয়েছিল ইউরোপিয়ান কাপ নামে, সেটাও এই দুই সাংবাদিকের ভাবনাপ্রসূত। দুজনের ভাবনা বাস্তবায়িত হতে বেশি সময় লাগেনি, ১৯৫৬ সাল থেকে ফ্রান্স ফুটবল বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার দেওয়া শুরু করে।
প্রথম দিকে পুরস্কারটা শুধু ইউরোপের খেলোয়াড়দের জন্য ছিল, তাই তখন একে বলা হতো ইউরোপিয়ান ফুটবলার অব দ্য ইয়ার। ১৯৯৫ সালে নিয়ম বদল হলো—ইউরোপের ক্লাবে খেলে এমন যেকোনো দেশের ফুটবলার মনোনীত হতে পারবেন। এরপর ২০০৭ সালে ব্যালন ডি’অর হয়ে গেল পুরো বিশ্বের পুরস্কার—যেকোনো দেশের পেশাদার ফুটবলার জিততে পারবেন।
২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত, ফিফার সঙ্গে চুক্তি করে এই পুরস্কার মিশে যায় ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার-এর সঙ্গে—নাম হয় ফিফা ব্যালন ডি’অর। কিন্তু ২০১৬-তে সেই সখ্য ভেঙে যায়। ব্যালন ডি’অর ফিরে আসে পুরোনো রূপে, আর ফিফাও চালু করে আলাদা পুরস্কার—দ্য বেস্ট ফিফা মেনস প্লেয়ার।
শুরুতে পুরস্কারের জন্য বিবেচ্য সময়কাল ছিল পঞ্জিকা বর্ষ। তবে ২০২২ সালে ফ্রান্স ফুটবল আবার এই নিয়মে বদল আনে, বিবেচনা করা শুরু হয় ফুটবল মৌসুম। ২০২৪ সাল থেকে ইউরোপিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (উয়েফা) ব্যালন ডি’অর গালা সহ-আয়োজন করছে, তবে ভোট আর নামের মালিকানা থাকছে ফ্রান্স ফুটবল-এর হাতেই।
ফ্রান্স ফুটবল ভোটারদের জন্য তিনটি মূল মানদণ্ড ঠিক করে দিয়েছে—১. ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স ও ম্যাচে প্রভাব, ২. দলগত অর্জন ও সাফল্য এবং ৩. মাঠে ও মাঠের বাইরে খেলোয়াড়সুলভ আচরণ।
শুরুতে শুধু ফুটবল সাংবাদিকদের ভোটেই ঠিক হতো ব্যালন ডি’অরজয়ী। ২০০৭ সালে জাতীয় দলের কোচ আর অধিনায়কেরাও ভোট দেওয়ার অধিকার পেলেন। তবে ২০১৬ সালে আবার শুধু সাংবাদিকদের ভোটের নিয়মে ফিরে গেল ফ্রান্স ফুটবল। ২০২২ সালে আবার এই নিয়মে বদল আসে, শুধু ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ ১০০-তে থাকা দেশের একজন করে সাংবাদিক পান ভোটাধিকার।
প্রথমে ফ্রান্স ফুটবল আর ফরাসি পত্রিকা লেকিপ-এর সাংবাদিকেরা মিলে তৈরি করেন ৩০ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা। এরপর শুরু হয় ভোট। এখন শীর্ষ ১০০ ফিফা র্যাঙ্কিং দেশের একজন করে সাংবাদিক ভোট দেন। প্রত্যেকে নিজের শীর্ষ-১০ ঠিক করেন—প্রথম স্থানে থাকা খেলোয়াড় পান ১৫ পয়েন্ট, দ্বিতীয় ১২, তৃতীয় ১০; এরপর ক্রমানুসারে ৮, ৭, ৫, ৪, ৩, ২ আর ১ পয়েন্ট।
সব ভোট যোগ করে যিনি সর্বোচ্চ পয়েন্ট পান, তিনিই ব্যালন ডি’অর জেতেন। সমান পয়েন্ট হলে প্রথম স্থান পাওয়া ভোটের সংখ্যা গুনে দেখা হয়, তাতেও সমান হলে দ্বিতীয় স্থানের ভোট দেখা হয়, এভাবে চলতে থাকে। পুরস্কার ঘোষণার পর সব ভোট প্রকাশ করা হয়।
আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি লিওনেল মেসি রেকর্ড আটবার জিতেছেন ব্যালন ডি’অর। তারপরই আছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো—পাঁচবার। ইয়োহান ক্রুইফ, মিশেল প্লাতিনি ও মার্কো ফন বাস্তেন জিতেছেন তিনবার করে। আলফ্রেদো দি স্তেফানো, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, কেভিন কিগান, কার্ল-হেইঞ্জ রুমেনিগে ও ব্রাজিলের রোনালদো জিতেছেন দুবার করে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে জিতেছেন ম্যানচেস্টার সিটির স্প্যানিশ মিডফিল্ডার রদ্রি।
সেরা খেলোয়াড়ের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় আরও অনেক বিভাগে পুরস্কার যুক্ত করেছে ফ্রান্স ফুটবল।
ব্যালন ডি’অর ফেমিনিন: প্রতি মৌসুমের সেরা নারী ফুটবলার। শুরু হয় ২০১৮ সালে।
কোপা ট্রফি: ২১ বছরের কম বয়সী সেরা খেলোয়াড়। এই ট্রফির নামকরণ হয়েছে ১৯৫৮ সালের ব্যালন ডি’অরজয়ী রেমন্ড কোপার নামে। পুরস্কার দেওয়া শুরু হয় ২০১৮ সাল থেকে।
লেভ ইয়াসিন ট্রফি: প্রতি মৌসুমের সেরা গোলরক্ষক। ১৯৬৩ সালের ব্যালন ডি’অরজয়ী রাশিয়ান গোলরক্ষক লেভ ইয়াসিনের নামে এই ট্রফিটির নামকরণ হয়েছে। পুরস্কার দেওয়া শুরু হয় ২০১৯ সালে।
জার্ড মুলার ট্রফি: ২০২১ সালে প্রথমবার রবার্ট লেভানডফস্কিকে ‘স্ট্রাইকার অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। জার্মান কিংবদন্তি জার্ড মুলারের মৃত্যুর পর ২০২২ সাল থেকে এই পুরস্কারের নাম পরিবর্তন করে ‘জার্ড মুলার ট্রফি’ রাখা হয়।
সক্রেটিস অ্যাওয়ার্ড: মানবিক কাজের জন্য ২০২২ সাল থেকে এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। পুরস্কারের নামকরণ হয়েছে কিংবদন্তি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার সক্রেটিসের নামে, যিনি ১৯৮০-এর দশকে ব্রাজিলের সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ‘করিন্থিয়ানস ডেমোক্রেসি’ আন্দোলনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
বর্ষসেরা পুরুষ ক্লাব: ২০২১ সাল থেকে দেওয়া শুরু হয়।
বর্ষসেরা নারী ক্লাব: ২০২৩ সাল থেকে।
ইয়োহান ক্রুইফ ট্রফি: বর্ষসেরা সেরা পুরুষ ও নারী কোচের জন্য এই পুরস্কার চালু হয় ২০২৪ সালে।
এবার কারা কোন বিভাগে সংক্ষিপ্ত তালিকায় আছেন, দেখুন ।
এবারের পুরস্কার দেওয়া হবে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর, প্যারিসের বিখ্যাত থিয়াত্র দ্যু শাতলে-তে।