Advertisement

ময়মনসিংহে ছাত্রদল নেতার ‘টর্চার সেল’, গান বাজিয়ে চলত নির্যাতন

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট, ২০২৫

ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক হিজবুল আলম ওরফে জিয়েসছবি: ফেবসুক থেকে নেওয়া
ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক হিজবুল আলম ওরফে জিয়েসছবি: ফেবসুক থেকে নেওয়া

নিজের ‘টর্চার সেলে’ তিনজনকে আটকে রেখে মারধর করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় আলোচনায় এসেছেন ময়মনসিংহের তারাকান্দার এক ছাত্রদল নেতা। তাঁর নাম হিজবুল আলম ওরফে জিয়েস। তিনি তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক।

তারাকান্দা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম মাঝিয়ালি। এখানে একটি মৎস্য খামার আছে হিজবুলের। সেই খামারের ছোট একটি ঘরকে তিনি ‘টর্চার সেল’ বানিয়ে গান বাজিয়ে মানুষকে নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ। সম্প্রতি সেখানে স্থানীয় তিন বাসিন্দাকে আটকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। পরে সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

হিজবুলের মারধরের শিকার হয়েছেন ময়মনসিংহ মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক ও মাঝিয়ালি গ্রামের বাসিন্দা মামুন সরকার। স্থানীয় বাজারে চাঁদার জন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিবাদ করায় তিনি হিজবুলের হামলার শিকার হন। এ ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে গতকাল সোমবার থানায় একটি মামলা করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, হিজবুল এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, মাদক সেবনকারী ও চাঁদাবাজ। তিনি স্থানীয় মাঝিয়ালি বাজারে বিভিন্ন দোকানদারের কাছ থেকে মালামাল নেওয়ার পর টাকা দেন না। ৮ আগস্ট হিজবুল স্থানীয় বাজারে হক মিয়ার সেলুনে চুল কাটিয়ে বিল পরিশোধ করেননি। টাকা চাইলে উল্টো পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন হিজবুল। একপর্যায়ে হক মিয়া ও তাঁর বড় ভাই লাক মিয়াকে মারধর করে দোকানে তালা লাগিয়ে দেন। বিষয়টি মামুনকে জানালে তিনি দোকান খুলে ব্যবসা করতে বলেন। পরের দিন ৯ আগস্ট দোকানটি খোলা পেয়ে হিজবুল ‘টাকা না দিয়া কার কথায় দোকান খুলছস’ বলে হক মিয়াকে মারধর করেন। তাঁকে রক্ষা করতে গিয়ে মামুন সরকারও মারধরের শিকার হন।

পরে মামুন সরকারের করা মামলায় গতকাল ভোরে হিজবুলের তারাকান্দার দিঘারকান্দা গ্রামের মো. রাফি (১৯) এবং মাঝিয়ালি উত্তরপাড়া গ্রামের মো. আবদুল্লাহকে (২০) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করে তারাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ টিপু সুলতান বলেন, হিজবুলকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
মামলার বাদী মামুন সরকার বলেন, ‘ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে কেউ এ ধরনের চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা করবেন; তা হতে পারে না। আমি সাংগঠনিক ও আইনগতভাবে কঠোর বিচার চাই। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, এলাকার যদি কেউ বলেন এই ছেলে অপরাধী নন, মাদক ব্যবসায়ী নন, তাহলে আমার কোনো অভিযোগ থাকবে না, আমি মামলা তুলে নেব। তিনি এলাকায় একটি টর্চার সেল করেছেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক এনে এখানে নির্মম নির্যাতন করেন। গ্রামপর্যায়ে টর্চার সেল নিয়ে এসেছেন, এটি মানা যায় না।’

প্রসঙ্গত, হিজবুল আলম ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর সাধারণ সম্পাদকের পদ পান। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তাঁর কোনো তৎপরতা দেখা না গেলেও গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এলাকা ‘শাসন’ করতে শুরু করেন নিজস্ব স্টাইলে।

বানিহালা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মকবুল হোসেন বলেন, ‘হিজবুলের টর্চার সেল আছে। সেখানে মানুষকে আটকে মারধর করার ভিডিও দেখেছি। ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বললেও আমরা তাঁকে কোনো কর্মকাণ্ডে পাইনি। আমরা এ অপকর্ম সমর্থন করি না।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, নিজের আস্তানায় নিয়ে মুঠোফোনে হিন্দি-বাংলা গান ছেড়ে একজনকে মারছেন হিজবুল। খোঁজ নিয়ে সেই ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করে প্রথম আলো। যাঁকে মারা হচ্ছিল, তাঁর নাম মো. জুয়েল মিয়া (২৭)। তিনি পেশায় দিনমজুর।

ভিডিওতে দেখা যায়, হিজবুল নিজের হাতে দেশি একধরনের বিশেষ অস্ত্র দেখিয়ে সঙ্গে থাকা অন্যজনকে মারতে বলেন। পরে সঙ্গে থাকা সেই ‍যুবককে মারতে থাকেন জুয়েল। একপর্যায়ে হিজবুলও মারধর করতে থাকেন। মারধরের শিকার অপর যুবকের পরিচয়ও শনাক্ত করে প্রথম আলো। তাঁর নাম রাসেল মিয়া (২৮)। তিনিও পেশায় দিনমজুর।

মাঠে ধানের জমিতে দিনমজুরি করা রুহুল আমিন ও রাসেল মিয়াকে খোঁজ করে আনা হয় উত্তর মাঝিয়ালি মোড়ে। আজ দুপুরে জুয়েল ও রাসেলের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, ঘটনাটি অন্তত ২০ দিন আগের। সে দিন ঘটনার শিকার হয়েছিলেন রুহুল আমিন নামের আরেকজন। রুহুল হচ্ছেন ‍জুয়েলের চাচাতো ভাই।

মো. জুয়েল মিয়া বলেন, হিজবুল পূর্বপরিচিত হওয়ায় তাঁর সঙ্গে মাঝেমধ্যে আড্ডা দিতেন তিনি। সম্প্রতি ওই ঘরের ভেতরে গেলে তাঁকে আটকে ফেলা হয়। বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত আটকে রাখে। তারপর তাঁর মুঠোফোনে রাসেল কল করলে তাঁকেও সেখানে যেতে বলা হয়। চাচাতো ভাই রুহুলকেও সেখানে নেওয়া হয়। তারপর তিনজনকে আটকে মারধর করা হয়।

মো. রাসেল মিয়ার অভিযোগ, ‘আমাকে ফোন দিয়ে নিয়ে আটকে মারধর করে। আমার কাছে ৪০ হাজার টাকা চাঁদা চেয়ে মারধর করে, সেটির ভিডিও করতে চায়। পরে আমি ১০ হাজার টাকা দেওয়ার কথায় রাজি হয়ে সেখান থেকে মুক্তি পাই। মারধর করে পাঠিয়ে দেওয়ার সময় কাউকে কিছু না বলতে বলে দেয়। আমাদের কেন আটকে মারধর করল, আমরা এর বিচার চাই।’

রুহুল আমিনকে এলাকায় পাওয়া না গেলেও তাঁর স্ত্রী তাসলিমা আক্তার বলেন, তাঁর স্বামীকে মারধর করে ৫০ হাজার টাকা হিজবুল পাবেন, এই মর্মে মুঠোফোনে স্বীকারোক্তি রেখেছেন। এখন বিপদের আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

স্থানীয় ইউনিয়ন যুবদলের কর্মী মোজাম্মেল সরকার বলেন, ভিডিওতে যা দেখা গেছে, তা ভয়াবহ। মধ্যযুগীয় কায়দায় গান বাজিয়ে ঘরে আটকে মারধর করে। পুলিশ ‘টর্চার সেলের’ তালা ভেঙে ভেতর থেকে মারধরের সরঞ্জাম ও বিভিন্ন ধরনের স্ট্যাম্প পেয়েছে। মানুষকে এখানে ধরে এনে জিম্মি করে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা বসিয়ে স্বাক্ষর রাখত। যার কাছে চাঁদা চাইত, না দিলেই মারধর করত, কাউকে মানত না। এলাকার সবাই তাঁর নির্যাতনের শিকার, কেউ ভয়ে মুখ খুলেন না। টিকটক আইডিতেও দেশি অস্ত্র নিয়ে তাঁর ভিডিও আছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে হিজবুল আলমের খোঁজ নিয়ে এলাকায় পাওয়া যায়নি। তাঁর ব্যবহৃত মুঠোফোনের নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া গেছে। তাঁর বাবা মঞ্জুরুল ইসলামকে মুঠোফোনে কল করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

তারাকান্দা উপজেলা ছাত্রদলের সদস্যসচিব মো. সাদ্দাম হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আগে হিজবুলের বিষয়ে কেউ কিছু জানাননি। জানালে আগেই ব্যবস্থা নেওয়া হতো।

মাঝিয়ালি বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী ননী দেবনাথ ও চা-দোকানি সাইফুল ইসলাম মণ্ডল অভিযোগ করেন, হিজবুল পণ্য নিয়ে দাম দিতে চান না। চাঁদা দাবি করেন। হুমকি দেন, চাঁদা না দিলে দোকান করা যাবে না।

তারাকান্দা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) লিটন চন্দ্র পালের নেতৃত্বে পুলিশ হিজবুলের ‘টর্চার সেলে’ আজ মঙ্গলবার ভোরে অভিযান চালায়। সেখান মানুষকে মারধরের দেশি সরঞ্জাম ও নন–জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প পায় পুলিশ।

প্রথম আলোর হাতে এসেছে টাকা গ্রহণের একটি চুক্তিপত্র। চুক্তিপত্রটি হয় হিজবুল ও সোহেল মিয়ার মধ্যে। সোহেল মিয়া উপজেলার করনগুয়া গ্রামের আবুল হোসেন ব্যাপারীর ছেলে। গত ১ জুন টাকা গ্রহণের তারিখ দেওয়া। ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রতিদিন ১ হাজার টাকা লাভ এবং ১০ দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করলে যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাওয়ার কথা উল্লেখ আছে। এতে শুধু সোহেল মিয়ার সই আছে।

তবে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সোহেল মিয়াকে শনাক্ত এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, তারা সোহেলকে শনাক্ত করে কী ঘটেছিল, তা জানার চেষ্টা করছে।

Lading . . .