‘চোখের সামনে বসতবাড়ি ভাইঙ্গা নিল, পোলাপান লইয়া কই যামু’
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

চার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে এক রাতে ঘর ছাড়তে বাধ্য হন শেরপুর সদর উপজেলার গৃহিণী নাজমা বেগম (৪৬)। চোখের সামনে নিজেদের শেষ আশ্রয়স্থলটি নদীতে বিলীন হতে দেখেন। এই অবস্থায় কোথায় যাবেন, কী করবেন—কিছুই বুঝতে পারছেন না। এমন অসহায়ত্ব প্রকাশ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভাগলঘর গ্রামের এই বাসিন্দা বলেন, ‘চোখের সামনে বসতবাড়ি ভাইঙ্গা নিল (ব্রহ্মপুত্র নদ), পোলাপান লইয়া কই যামু?’
আপাতত দিনমজুর স্বামী আবদুল্লাহ ও সন্তানদের নিয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন নাজমা। তবে ভবিষ্যতে কোথায় যাবেন, এই ভেবে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। ব্রহ্মপুত্র নদে বসতভিটা হারানোর এই কষ্ট কিংবা অসহায়ত্ব শুধু নাজমা বেগমের একার নয়, চরপক্ষীমারি ইউনিয়নের দক্ষিণ ভাগলঘর গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবারের একই দুর্দশা। পরিবারগুলোর অভিযোগ, সরকারি উদ্যোগে ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছে তারা।
গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন দেখা যায়, চরপক্ষীমারি ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে দক্ষিণ ভাগলঘর গ্রামের একাংশে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। গ্রামটির প্রায় ৫০০ মিটার এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যেই অনেকের বসতভিটা নদে পুরোপুরিভাবে বিলীন হয়ে গেছে। আবার কোথাও নদের পাড় ঘেঁষে থাকা শূন্য ভিটায় উঁকি দিচ্ছে বাঁশের খুঁটি। এগুলো এখন সেই দুঃসহ বাস্তবতার সাক্ষী যেন। অনেকে তড়িঘড়ি নিজেদের ঘর থেকে আসবাব সরিয়ে কোনোরকমে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে রেখেছেন।
ব্রহ্মপুত্রের তীর থেকে মাত্র ২০ মিটার দূরে আছে ভাগলঘর দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদ ও সামাজিক কবরস্থান। ভাঙন রোধ করা না গেলে যেকোনো সময় এগুলো নদে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন গ্রামবাসী। এর মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উদ্যোগে ভাঙনকবলিত এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলার জন্য বালু ভরার কাজ চলতে দেখা যায়।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চরপক্ষীমারি ইউনিয়নের দক্ষিণ ভাগলঘর গ্রামে প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবারের বসবাস। লোকসংখ্যা এক হাজারের বেশি। এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। গত দুই বছরে গ্রামটির শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি নদে বিলীন হয়ে গেছে। অনেক পরিবার জীবিকার সন্ধানে এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গেছে। কেউ কেউ আবার মাটির টানে আত্মীয়স্বজনের জায়গায় কিংবা অন্যের বাড়িতে ঘর তুলে গ্রামেই অবস্থান করছেন। সম্প্রতি নতুন করে ভাঙনে প্রায় ৩০টি পরিবারের বসতভিটা নদে চলে গেছে। সব হারিয়ে নিঃস্ব এসব পরিবার আত্মীয়স্বজন কিংবা অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। বাড়তি কোনো জমি না থাকায় এবং আর্থিক সংকটে পড়ায় স্ত্রী-সন্তান ও মা-বাবাকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে।
ভাঙন আতঙ্কে আছেন আহেদ আলী ও পারভিন বেগম দম্পতি। তাঁদের ৯০ শতাংশ বসতভিটায় দুটি টিনের ঘর আছে। গত দুই বছরে তাঁদের ৩ বিঘা ফসলি জমি নদে বিলীন হয়ে গেছে। পারভিন বেগম বলেন, ‘এখন যদি ভাঙন ঠেকানো না যায়, তাইলে তিন মেয়ে নিয়ে আমরা মহাবিপদের মধ্যে পড়মু। সামনে মেয়েদের বিয়েশাদিও দিয়োন লাগব। বাড়িঘর ভাইঙ্গা গেলে আমরা ভূমিহীন হয়ে পড়মু। এই দুশ্চিন্তায় রাইতে ঠিকমতো ঘুমাইতে পারি না।’
দক্ষিণ ভাগলঘর গ্রামের বাসিন্দা শহিদ মিয়া বলেন, ‘ভাঙনে আমি তিনবার বাড়ি বানাইছি। আবার ভাঙন শুরু হয়েছে, এর কাছে আমরা নিরুপায়।’
ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে ১৫ সেপ্টেম্বর এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে শেরপুর পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভাগলঘর গ্রামের ৫০০ মিটার নদের ভাঙনকবলিত অংশ পরিমাপ করা হয়েছে। দ্রুতগতিতে ১৩০ মিটার অংশে গত সোমবার থেকে জিও ব্যাগ ফেলা শুরু হয়েছে। এই অংশে মোট প্রায় ৮ হাজার ব্যাগ ফেলা হবে।
শেরপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আখিনুজ্জামান বলেন, ওই ১৩০ মিটার অংশে জিও ব্যাগের সঙ্গে জিও টিউব ব্যাগও ফেলা হবে। এতে ভাঙন রোধে সহায়তা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পরবর্তী সময় এই অংশে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রকল্পের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হবে।