প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

আলোর গতি নিয়ে আমাদের অনেক আগ্রহ আছে। আলোর গতি শুধু অঙ্কনির্ভর একটি সংখ্যা নয়। আলোর গতি আমাদের বাস্তবতাকে সংজ্ঞায়িত করা একটি মহাজাগতিক ধ্রুবক। আর তাই মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিসীমা হিসেবে আলোর গতিকে বিবেচনা করে থাকেন বিজ্ঞানীরা। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২ লাখ ৯৯ হাজার ৭৯২ কিলোমিটার বা ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল। শূন্য মাধ্যমে আলোর গতি হলো মহাবিশ্বের দ্রুততম গতি। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো তথ্য বা বস্তু আলোর গতিকে অতিক্রম করতে পারে না। এ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, আমার বাকি জীবন আমি আলো কী, তা নিয়েই ভাবতে চাই।
বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আগে ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও শুধু লন্ঠন ও একটি স্টপওয়াচ দিয়ে আলোর গতি পরিমাপ করার চেষ্টা করেন। তিনি একজন সহকর্মীকে একটি দূরের পাহাড়ে দাঁড় করিয়ে তাঁর লন্ঠনটি চালু করতে বলেন ও ফিরতি সংকেতের জন্য অপেক্ষা করেন। সংকেত আসা-যাওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য তিনি ধরতে পারেননি। তখন তিনি মনে করেন, যদি আলোর কোনো গতি থাকে, আসলে তা অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত। মানুষের পক্ষে আলোর গতি পরিমাপ করা সম্ভব নয়।
আলোর গতি সসীম—এ ধারণার প্রথম বাস্তব প্রমাণ হয় ১৬৭৬ সালে। ডেনমার্কের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওলে রোমার বৃহস্পতির চাঁদ আইওর গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তিনি লক্ষ করেন, ভিন্ন গ্রহে চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর কক্ষপথে এর অবস্থানের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। পৃথিবী যখন বৃহস্পতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল, তখন আইওকে কিছুটা দেরিতে আসছে বলে মনে হয়। আর যখন এটি কাছে আসছিল, তখন আগে আসছে মনে হচ্ছিল। রোমার যুক্তি দেন, এই পরিবর্তন আইওর কারণে হচ্ছে না। মহাকাশের বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করতে আলোর যে সময় লাগছে, তার কারণে হচ্ছে। দেরির তুলনা করে তিনি আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার অনুমান করেন। যদিও সেটি নিখুঁত ছিল না। প্রথমবারের মতো আলো অসীম দ্রুতগতিতে চলে না—এটি প্রমাণিত হয়।
প্রায় দুই শতাব্দী পর ফ্রান্সের পদার্থবিদ হিপ্পোলিট ফিজো প্রথম স্থলে আলোর গতি পরিমাপ করেন। ১৮৪৯ সালে তিনি একটি দ্রুত ঘূর্ণমান চাকতির ফাঁক দিয়ে ৮ কিলোমিটার দূরে একটি আয়নায় আলোর একটি রশ্মি পাঠান। যখন ফিরতি রশ্মিটি পরবর্তী চাকতিতে বাধাগ্রস্ত হয়, তখন তিনি আলোর গতি গণনা করেন প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ ১৩ হাজার কিলোমিটার।
উনিশ শতকের শেষের দিকে পদার্থবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন, আলো একটি অদৃশ্য মাধ্যম লুমিনিফেরাস ইথারের মধ্য দিয়ে চলে। অনেকটা শব্দ যেমন বায়ুর মধ্য দিয়ে চলে তেমন। যদি পৃথিবী এই ইথারের মধ্য দিয়ে চলে, তবে আলোর গতি দিকভেদে পরিবর্তিত হওয়া উচিত। ১৮৮৭ সালে আলবার্ট মিশেলসন ও এডওয়ার্ড মোরলি একটি নির্ভুল যন্ত্র দিয়ে গতি পরীক্ষা করেন। আলোর একটি রশ্মিকে দুটি লম্ব পথে বিভক্ত করা হয়। আয়নায় প্রতিফলিত করে আবার একত্র করা হয়। যদি একটি রশ্মি ইথারের মধ্য দিয়ে স্রোতের বিপরীতে চলত, তা তা সামান্য পরে পৌঁছাত। কিন্তু কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। আলোর গতি সবদিকেই একই ছিল। তখন ইথারের তত্ত্ব বদলে যায়।
১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন জানান, আলোর গতি সব জায়গায় সব সময় এক থাকে। কোনো ইথার নেই। আলোর গতির ধ্রুবক বজায় রাখার জন্য স্থান ও কাল নিজেই পরিবর্তিত হয়। গতিশীল ঘড়ি ধীরে চলে আর গতিশীল বস্তু সংকুচিত হয়। তখন ভর ও শক্তি একে অপরের সঙ্গে বিনিময়যোগ্য হয়ে ওঠে।
সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস