Advertisement

এখানকার অনুভূতি জীবনের গভীরতাকে নতুন মাত্রা দেয়

জাগোনিউজ টোয়েন্টিফোর

প্রকাশ: ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

এখানকার অনুভূতি জীবনের গভীরতাকে নতুন মাত্রা দেয়
এখানকার অনুভূতি জীবনের গভীরতাকে নতুন মাত্রা দেয়

পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয়, পরান-প্রিয়! চাহিতে যেমন আগের দিনে তেমনি মদির চোখে চাহিও।

মানবচেতনার সীমা ছুঁয়ে যায় এমন অভিজ্ঞতা খুব কমই হয়—আজ আমি এক সেই মুহূর্তের সাক্ষী হলাম। রকি পর্বতমালার কোলে দাঁড়িয়ে যখন চোখ বোলালাম, তখন চোখের সামনে বিস্তীর্ণ ভিক্টোরিয়া গ্লেসিয়ার যেন এক নিখিল ক্যানভাসে সৃষ্টির মহিমা ফুটিয়ে তুলছিল। বরফের হিমবাহ, ঝলমলে হ্রদের জল, পাহাড়ের চূড়া—সবকিছু একত্রে যেন বলে, ‘দেখো, এই সৌন্দর্য তোমার, এই শান্তি তোমার।’

গ্লেসিয়ারের প্রতিটি কণা যেন কথার চেয়ে গভীর। সূর্যের আলো পড়লেই সে খেলে, নীলাভ ছায়ায় রূপান্তরিত হয়, যেন সৃষ্টিকর্তার অব্যক্ত সৌন্দর্য আমাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করছে। মানুষের মন চঞ্চল হলেও এখানে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব হয়—একটি ধ্রুব সত্যের সঙ্গে সংযুক্তির মতো অনুভূতি।

ভিক্টোরিয়ার নামে নামকরণ হওয়া এই গ্লেসিয়ার এবং রাজকন্যা লুইসের নামে হ্রদ, প্রতিটি স্রোত যেন কাব্য হয়ে প্রবাহিত হয়। হিমবাহের গলিত জল আনে সূক্ষ্ম দানার গ্লেসিয়াল পলি, যা আলোয় প্রতিফলিত হয়ে ফিরোজা রঙের দুলিতে রূপান্তরিত হয়। প্রতিটি প্রতিফলন যেন বলে, ‘প্রকৃতির নিখুঁত গাথনি এবং মানুষের অনুভূতি এক হয়ে ওঠে।’

পাহাড়-পর্বত, বন, পশুপাখি—সবকিছু মিলেমিশে নীরবতার সুর বাঁধে। সেই নীরবতায় বোঝা যায়, মা-বাবা, প্রকৃতি এবং সৃষ্টির মহিমা—সবকিছু আমাদের কল্যাণে একত্রে কাজ করছে। এখানে দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারি, মানুষের মন শুধু দেখতে নয়, অনুভব করতেও প্রস্তুত। প্রকৃতির সৌন্দর্য আমাদের মনে এক নীরব জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দেয়: আমরা কি এই পৃথিবীর সঙ্গে সঠিকভাবে সংযুক্ত?

এখানকার অনুভূতি জীবনের গভীরতাকে নতুন মাত্রা দেয়

এখানকার অনুভূতি জীবনের গভীরতাকে নতুন মাত্রা দেয়

নয়নাভিরাম লেক লুইসের ফিরোজা রঙ, ভিক্টোরিয়ার বিশাল হিমবাহ, পাহাড়ের গম্ভীরতা—সবকিছু একত্রে একটি অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করে। এখানে দাঁড়ানো মানে শুধুই দেখা নয়; এখানে দাঁড়ানো মানে অনুভব করা, স্বপ্নে বিভোর হওয়া এবং মহিমার সামান্য ছোঁয়া পাওয়া।

রকি পর্বতমালার এই কোণে প্রকৃতি আমাদের শেখায়—সুন্দরতা, শান্তি এবং সৃষ্টির নিখিলতা কোনো বইয়ে লেখা থাকে না। তাকে অনুভব করতে হয়, তাকে হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। আর সেই অনুভূতিই আমাদের মানবিকতা এবং জীবনের গভীরতাকে এক নতুন মাত্রা দেয়।

রকি পর্বতমালার কোলে দাঁড়িয়ে আমি প্রথমে অনুভব করলাম এক অমর শান্তি। ভিক্টোরিয়া গ্লেসিয়ারের বরফের চিল্লিত সাদা ছায়া, লেক লুইসের ফিরোজা জল এবং পাহাড়ের চূড়ার গম্ভীরতা যেন এক শাশ্বত ক্যানভাসে আঁকা হয়েছে। হিমবাহের গলিত জল যখন সূর্যের আলোয় ঝলমল করে, তখন মনে হয় প্রকৃতি নিজের কবিতা লিখছে—শব্দের নয়, আলো এবং ছায়ার ছন্দে।

দিনের আলো হ্রদের জলে নাচতে থাকে, আর আমি হারিয়ে যাই সেই নীলাভ স্বপ্নের মাঝে। চারপাশে পাহাড়, বন এবং নীরবতার মধ্যে পশুপাখির ক্ষুদ্র সঙ্গীত—সবকিছু মিলেমিশে হৃদয়ে এক অমোঘ অনুভূতি তৈরি করে। মনে হলো, মা-বাবার ভালোবাসা, সৃষ্টিকর্তার রহমত এবং পৃথিবীর সৌন্দর্য একসাথে আমার চারপাশে উপস্থিত।

তারপর যাত্রা শুরু হলো উত্তরে, নর্ডিক অঞ্চলের দিকে। হারডাঙ্গারভিড্ডার বিস্তৃত পর্বতমালা এবং হর্নিনডালসজোর গভীর হ্রদে পা রাখতে আমি অনুভব করলাম এক নতুন প্রহর। এখানকার শান্ত জল, ফিরোজা আকাশের প্রতিফলন এবং পর্বতের গম্ভীরতা রকি পর্বতের সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি স্বপ্নময় সেতু তৈরি করল—দুই ভিন্ন ভূখণ্ডের মধ্যে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সাদৃশ্য।

এখানকার অনুভূতি জীবনের গভীরতাকে নতুন মাত্রা দেয়

এখানকার অনুভূতি জীবনের গভীরতাকে নতুন মাত্রা দেয়

নরওয়ের সেই শীতল বাতাস, হিমবাহের ক্ষুদ্র কণার ঝলক এবং হ্রদের জলরাশিতে প্রতিফলিত নীলাভ আভা—সবকিছু লেক লুইসের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে এক জাদুকরী আবহ সৃষ্টি করল। মনে হলো, প্রকৃতি শুধু দৃশ্য নয়; এটি অনুভূতি, এটি কাব্য, এটি এক নীরব গল্প যা আমার হৃদয়ে স্থায়ীভাবে খোদিত হয়ে গেলো।

রকি বা নর্ডিক—ভূখণ্ড যেকোনো হোক না কেন, প্রকৃতির এই নিখিল সৌন্দর্য মানবকে শেখায়—প্রত্যেকটি মুহূর্ত উপভোগ করতে, চোখে দেখতে নয় বরং মনে ধারণ করতে। হিমবাহের গলিত জল, পাহাড়ের গম্ভীরতা, ফিরোজা হ্রদ—সবকিছু একত্রে আমাদের জীবনের গভীরতাকে স্পর্শ করে এবং বোঝায়, প্রকৃতি ও মানুষ একে অপরের গল্পের অংশ।

জীবনের কোনো এক সময়ের দেখা হঠাৎ মনে পড়ে গেলো—ছোটবেলার শেখা কবিতা, গোলাম মুস্তাফার শব্দে ভরা:

‘নিখিলের এত শোভা, এত রূপ, এত হাসি-গান,
ছাড়িয়া মরিতে মোর কভু নাহি চাহে মন-প্রাণ।
এ বিশ্বের সব আমি প্রাণ দিয়ে বাসিয়াছি ভালো—
আকাশ, বাতাস, জল, রবি-শশী, তারকার আলো।
সকলেরই সাথে মোর হয়ে গেছে বহু জানা-শোনা,
কত কি-যে মাখামাখি, কত কি-যে মায়া-মন্ত্র বোনা।
বাতাস আমারে ঘিরে খেলা করে মোর চারিপাশ,
অনন্তের কত কথা কহে নিতি নীলিমা আকাশ।
চাঁদের মধুর হাসি, বিশ্বমুখে পুলক চুম্বন,
মিটিমিটি চেয়ে থাকা তারকার করুণ নয়ন,
বসন্ত নিদাঘ-শোভা, বিকশিত কুসুমের হাসি,
দিকে দিকে শুধু গান, শুধু প্রেম-ভালোবাসাবাসি…’

আজ হাঁটছি বাড়ির পাশে, বাল্টিক সাগরের উপোশাখা দিয়ে—পাহাড়, জঙ্গল আর নর্ডিক ম্যালারেন। সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ আগে আমি আর আমার সহকর্মীনি মারিয়া। আমরা দুজনেই প্রকৃতির প্রেমিক; সময় পেলেই হাঁটতে, ঘুরতে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ি। স্মৃতি চারণের যেন এক অপূর্ব অনুভূতি। সেই অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে অতীতের স্মৃতিগুলো এতো দিন পরে মনে পড়ে গেলো।

রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com

Lading . . .